গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ শেষে তাদের ঘিরে দিনভর হামলা ও সংঘর্ষের পর রাতে ফাঁকা দেখা গেছে জেলা শহর। কোথাও মানুষের যাতায়াত দেখা যায়নি। তবে শহরের বিভিন্ন সড়কে পড়ে আছে লাঠিসোঁটা, ইটপাটকেলসহ সংঘর্ষে জড়ানোর বিভিন্ন সরঞ্জাম।
বুধবার রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত শহর ঘুরে দেখা যায়, শহরের প্রায় সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। তবে বিভিন্ন মহল্লার ওষুধের দোকানগুলো খোলা আছে। রাস্তায় নেই কোনও যানবাহন। পুরো রাস্তাজুড়ে রয়েছে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। শহরের পুলিশ লাইনস থেকে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে গাছের গুঁড়ি, বাঁশ এবং ইট দিয়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। শহরের প্রাণকেন্দ্র লঞ্চঘাটে আগুনের ধোঁয়া দেখা যায়। গোটা শহরজুড়ে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। যেন জনমানবহীন এক শহর।
সন্ধ্যা থেকে শহরের প্রতিটি মসজিদের মাইকে ১৪৪ ধারা জারির কথা জানিয়ে বলা হয়েছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন বাহিরে বের না হয়।
রাত ১০টার দিকে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যারা আহত অবস্থায় ভর্তি আছেন, তারা গ্রেফতার এড়ানোর জন্য সেখান থেকে কৌশলে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আহত কয়েকজনের স্বজন জানান, এখানে থাকলে তাদের মামলার আসামি হিসেবে গ্রেফতার করতে পারে পুলিশ। তাই সম্পূর্ণ চিকিৎসা না নিয়েই চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন আহতরা।
রাতে শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্র সারাদিনের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নাইটগার্ড এবং সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করছেন, তারা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের গেটে তালা দিয়ে ভেতরে অবস্থান করছেন। কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। রাস্তায় লোকজন চোখে পড়েনি। শহরের বিভিন্ন অলিগলি থেকে শুরু করে সব জায়গায় নীরবতা বিরাজ করছে। তবে শহরের প্রবেশপথ এবং বাহিরপথে পুলিশের পাশাপাশি অতিরিক্ত আর্মড পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তারা সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তল্লাশি করছে। গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে অন্য সময় রাতে লোকের সমাগম থাকে চোখে পড়ার মতো, সেখানে দেখা গেছে শূন্যতা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়া তেমন কোনও লোক চোখে পড়েনি।
তবে সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি টিম শহরে টহল দিচ্ছে।
এদিকে, গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন এলাকার পুরুষ সদস্যরা অন্য জেলায় এবং বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেছেন বলে জানিয়েছেন তাদের পরিবারের লোকজন।
এর আগে বিকাল পৌনে ৩টার দিকে শহরের পৌর পার্কে এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পরে জেলা প্রশাসক মো. কামরুজ্জামান জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, এনসিপির সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল ব্যক্তি লাঠিসোঁটা নিয়ে নেতাকর্মীদের ঘিরে হামলা চালান। তারা চারদিক থেকে এনসিপির নেতাকর্মী ও পুলিশের গাড়ি আটকে দেয়। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এনসিপির নেতাকর্মীরা অন্য দিক দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
হামলার ঘটনার পর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই হামলা চালিয়েছেন। এ সময় পুলিশ-সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তাদের (এনসিপি) বলা হয়েছিল, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু তারা সমাবেশস্থলে এসে দেখেন পরিস্থিতি ঠিক নেই।
এর আগে বেলা পৌনে ২টার দিকে ২০০ থেকে ৩০০ লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে এনসিপির সমাবেশস্থলে যায়। সে সময় মঞ্চের আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে দ্রুত আদালত চত্বরে ঢুকে পড়েন। একই সময়ে মঞ্চে ও মঞ্চের সামনে থাকা এনসিপির নেতাকর্মীরাও দৌড়ে সরে যান। যারা হামলা চালান, তারা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে এনসিপির নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন।
একপর্যায়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। এনসিপির নেতাকর্মী ও পুলিশ এক হয়ে ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা পালিয়ে যান। বেলা ২টা ৫ মিনিটে সমাবেশস্থলে পৌঁছান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে সমাবেশ করে এনসিপি। সমাবেশ শেষে এনসিপির নেতাকর্মীদের ঘিরে হামলার ঘটনা ঘটে।
১ জুলাই থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে এনসিপি। এর মধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় এই কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। মাসব্যাপী এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ গোপালগঞ্জে পদযাত্রা করছে দলটি। গতকাল মঙ্গলবার দলের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এই কর্মসূচিকে ‘১৬ জুলাই: মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই পদযাত্রাকে ঘিরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সদর উপজেলার উলপুর-দুর্গাপুর সড়কের খাটিয়াগড় চরপাড়ায় পুলিশের গাড়িতে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। খবর পেয়ে ওই এলাকা পরিদর্শনে যান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রাকিবুল হাসান। সেখান থেকে ফেরার পথে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সদর উপজেলার কংশুরে ইউএনওর গাড়িতে হামলা করা হয়। এ ঘটনায় তার গাড়ির চালক আহত হন।
ইউএনও এম রাকিবুল হাসান বলেন, ‘এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে পুলিশের গাড়িতে হামলার অপ্রীতিকর ঘটনা জানার পর ওই এলাকায় পরিদর্শনে যাই। সেখান থেকে ফেরার পথে কংশুরে পৌঁছালে, একদল লোক আমাদের গাড়িতে হামলা করে। গাড়ির চালক মোহাম্মদ হামিম আহত হয়েছেন।’