সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে সাতক্ষীরায় টানা ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। এতে জেলার পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক ও মৎস্য চাষিরা।
সোমবার (১৪ জুলাই) ভোর থেকে শুরু হওয়া বর্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে বিল, খাল, পুকুর ও রাস্তাঘাট। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষক।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত জেলায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪ জুলাই— ১২৯ মিলিমিটার।
অফিসটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, সাগরে লঘুচাপের কারণে গত কয়েকদিন ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সোমবার থেকে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে জুলাইজুড়েই বৃষ্টিপাতের প্রবণতা থাকতে পারে।
তিনি আরও বলেন, চলমান বর্ষণে সাতক্ষীরায় এখন পর্যন্ত মোট ২৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবারও বজ্রসহ মাঝারি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।
পৌরসভার কামালনগর, রাজারবাগান, গদাইবিল, বদ্দিপুর কলোনি, মুনজিতপুর, কাটিয়া, গড়েরকান্দা, ইটাগাছা সরেজমিনে ঘুরে দেখে গেছে, অধিকাংশ মানুষের বাড়ির উঠানে পানি, অনেক ঘরের মধ্যেও পানি প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার আলিপুর, কাশেমপুর, বকচরা, বালিয়াডাঙ্গা, বাবুলিয়াসহ ১৪ ইউনিয়নের এসব অঞ্চলের বহু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়ায় অনেকেই মাচান বানিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।
কলাগাছের ভেলায় চলাফেরা করতে দেখা গেছে কিছু পরিবারকে। পানিবন্দি পরিবারগুলোতে রান্নাবান্না বন্ধ রয়েছে। চুলায় আগুন জ্বালানো তো দূরের কথা, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন তারা।
ফসল ও ঘেরে বড় ক্ষতি
টানা বর্ষণে জেলার আমনের বীজতলা, আউশ ধান ও সবজিক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে বহু মাছের ঘের।
সাতক্ষীরা পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে দেখা দিয়েছে চরম জলাবদ্ধতা। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমরসমান। ফলে স্থানীয়দের চলাচলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার কামালনগর এলাকার বাসিন্দা শরিফা বেগম বলেন, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শ্যামনগর থেকে সাতক্ষীরা শহরে এসে বাস করছি। কিন্তু এখানে এসেও শান্তি নেই, প্রতিবছর বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে পানি ওঠে। আমাদের এলাকা কমপক্ষে ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে।
শহরের পাশাপাশি উপকূল প্লাবিত, চিংড়িসহ ভেসে যাচ্ছে মাছ
টানা বর্ষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে জেলার উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ। শত শত পুকুর ও চিংড়ি ঘের একাকার হয়ে গেছে।
শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালীনি এলাকার মৎস্য চাষি গোলাম হোসেন বলেন, এ বছর আমি দুটি পুকুরে রুই, কাতলা ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করেছিলাম। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে পুকুর ডুবে গিয়ে সব মাছ হয়তো ভেসে গেছে।
মৎস্য চাষিদের দাবি, খাল-নদীর সঙ্গে পুকুরের সংযোগ হয়ে বহু পুকুর ও ঘেরের সীমানা হারিয়ে গেছে। ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় মাছ ভেসে গিয়ে কয়েক লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, সোমবার ভোর থেকে নতুন করে আবার শুরু হওয়া বর্ষণে সাতক্ষীরা শহরতলীর নিম্নাঞ্চলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। এতে পানিতে তলিয়ে গেছে বিল, খাল, পুকুর ও রাস্তাঘাট। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকরা। জলাবদ্ধতা আমাদের একটি স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে আছে। আমরা স্থায়ী সমাধান চাই।
প্রশাসনের উদ্যোগ
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শোয়াইব আহমাদ জানান, পানি নিষ্কাশনের জন্য স্লুইস গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫০ কিলোমিটার খাল ও সেচনালা সংস্কার করা হয়েছে।
কৃষিতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষবিদ সাইফুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ১৬২ হেক্টর আউশ, আমন বীজতলা ১০৬ হেক্টর, ৪৪ হেক্টর শাক সবজির ক্ষতি হয়েছে। এতে টাকার অঙ্কে দেড় কোটির টাকার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। সদর ছাড়া বাকি ছয় উপজেলায় আমাদের ভালো ফলন হবে হবে। আশা করছি, আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।