চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সে সময় দিনে পাঁচ থেকে সাত জন করে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। বর্তমানে জুলাই মাসে দিনে ১২ থেকে ১৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে মশার ওষুধ ছেটাতে সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু মশাবাহিত রোগ। এ রোগ থেকে বাঁচতে হলে মশা মারতে হবে এবং মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। তবে নগরীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, ডেঙ্গু রোগ বহুগুণ বাড়লেও ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না সিটি করপোরেশনের কর্মীদের। এদিকে, থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে দিনের পর দিন বিভিন্ন স্থানে জমে থাকছে পানি। এতে বাড়ছে মশার প্রজনন। এমন পরিস্থিতিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, সোমবার (১৪ জুলাই) জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে সাত জন। রবিবারের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের দিন ২৪ ঘণ্টায় ২৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৬১১ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। তাদের ২৭৯ জন নগরীর এবং ৩৩২ জন জেলার অন্যান্য এলাকার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে পুরুষ ৩৩৯ জন, নারী ১৭৪ জন এবং শিশু ৯৮ জন।
আক্রান্তদের মধ্যে জানুয়ারিতে ৭০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৮ জন, মার্চে ২২ জন, এপ্রিলে ৩৩ জন, মে মাসে ১১৬ জন, জুনে ১৭৬ জন এবং চলতি মাসের প্রথম ১৩ দিনে ১৬৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে, চলতি বছর জেলার ১৫টি উপজেলায় আক্রান্ত ৩৩২ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বাঁশখালীতে ১০৪ জন। এ ছাড়া সীতাকুণ্ডে ৭৫ জন, সাতকানিয়ায় ২৬ জন, আনোয়ারায় ২৫ জন, লোহাগাড়ায় ২৩ জন, রাউজানে ১৩ জন, পটিয়ায় ১১ জন, কর্ণফুলীতে ১০ জন, হাটহাজারী ও মীরসরাইয়ে ৮ জন করে, রাঙ্গুনিয়া ও চন্দনাইশে ৭ জন করে, বোয়ালখালী ও ফটিকছড়িতে ৬ জন করে এবং সন্দ্বীপে ৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।
এর আগের বছর ২০২৪ সালে জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৪ হাজার ৩২৩ জন এবং মারা গেছেন ৪৫ জন। ২০২৩ সালে আক্রান্ত হন ১৪ হাজার ৮৭ জন এবং মারা গেছেন ১০৭ জন। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৫ হাজার ৪৪৫ জন এবং মারা যান ৪১ জন।
নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন সঙ্গীত আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মুনতাসির উদ্দিন রাফি জানান, এ এলাকায় গত তিন মাসের মধ্যে একদিনও মশার ওষুধ ছিটাতে সিটি করপোরেশনের কোনও কর্মীকে দেখা যায়নি। অথচ এ এলাকায় মশার উৎপাত বেড়েছে বহু গুণ। ওষুধ ছিটানো নিয়ে পর্যাপ্ত তদারকি না থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।
একই অভিযোগ নগরীর বহদ্দারহাট ফরিদার পাড়া এলাকার বাসিন্দাদের। মাঈন উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি জানান, খাল-নালার পাড়ে এলাকাটি হওয়ার কারণে মশার উৎপাত অনেকটাই বেশি। তবে সিটি করপোরেশনের লোকজনকে মাসে একবারও ওষুধ ছিটাতে দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে মশাবাহিত রোগ বাড়ছে।
সম্প্রতি সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিচালিত এক জরিপে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে নগরের ছয়টি এলাকাকে ‘লাল’, পাঁচটিকে ‘হলুদ’, সাতটিকে ‘নীল’ এবং চারটি এলাকা ‘সবুজ’ তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে এসব এলাকায়ও মশক নিধন কার্যক্রম দৃশ্যমান না হওয়ার অভিযোগ বাসিন্দাদের।
এ প্রসঙ্গে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি)-এর অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। তবে হাসপাতালে বেশি ভর্তি হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ডেঙ্গুর প্রকোপ সামনে বাড়বে কিনা তা এখনও বলা যাচ্ছে না। গেলো বছর বৃষ্টির পরও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। এবার সেরকম হবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। তবে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত রোগ। এ রোগ থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই মশা নিধন করতে হবে। অর্থাৎ মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সারাবছর স্প্রে ও ফগিং কার্যক্রম চলে। ক্রাশ কর্মসূচি হটস্পট ধরে করা হচ্ছে। ওষুধ ছিটানোর জন্য ২১০ জন কর্মী আছেন। তারা নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে কাজ করছেন। এর মধ্যে বড় ওয়ার্ড গুলোতে ৭ জন এবং ছোট ওয়ার্ডগুলোতে ৫ জন লোহ ওষুধ ছিটানোর জন্য কর্মরত আছেন। এর বাইরে ৭২ জন সদস্য নিয়ে ছয়টি স্পেশাল টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমগুলো ডেঙ্গু রোগী যেখানে শনাক্ত হচ্ছে সেসব এলাকায় নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে নগরবাসী প্রতিদিনই অভিযোগ জানাচ্ছেন। আগে দৈনিক ৫ থেকে ৭ জন অভিযোগ জানালেও ইদানীং অভিযোগের হার কিছুটা বেড়েছে। এখন দৈনিক ১২ থেকে ১৫ জন ফোন করে অভিযোগ জানাচ্ছেন। তাদের অভিযোগ নোট করে প্রয়োজনীয় ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বর্তমানে সিটি করপোরেশনে ৬ মাসের ওষুধ মজুত আছে।’
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাড়ছে। তবে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। মশক নিধনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আরও জোরদার করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গু হলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে বাসায় চিকিৎসা নেওয়া যাবে। তবে কোনও ধরনের জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে যেতে হবে। বিশেষ করে যাদের দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগ রয়েছে, যেমন– কিডনি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।’
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের তিনটি মেডিসিন ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্নার করা হয়েছে। রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আমাদের প্রস্তুতির ঘাটতি নেই। ডেঙ্গুর ব্যবস্থাপনায় আমাদের প্রত্যেক চিকিৎসককে অভিজ্ঞ বলা যায়।’