ধানের মৌসুমে অস্থির চালের বাজার, কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা
বাংলাদেশ

ধানের মৌসুমে অস্থির চালের বাজার, কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা

দেশে ধান-চালের অন্যতম উৎপাদনস্থল নওগাঁ ও দিনাজপুর জেলা। উৎপাদনস্থল হওয়ায় এখানে চালের দাম কিছুটা কম থাকে। তবে এবার হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। চলতি বছর বোরো ধানের মৌসুমে অস্থির হয়ে উঠছে চালের বাজার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ধরনভেদে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। যা কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা।

ক্রেতারা বলছেন, দুই জেলায় নতুন ধান বাজারে উঠেছে। নতুন ধান উঠার এক মাস না যেতেই বেড়েছে প্রায় সব ধরনের চালের দাম। ধানের মৌসুমে কেন চালের দাম বাড়লো, সে কারণ জানা নেই তাদের। বিক্রেতারা বলছেন, বোরো ধানের দাম হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরু তথা মিনিকেট চালের দাম এখন বেশি। সরু চালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে মোটা ও মাঝারি চালের দাম বেড়ে গেছে।

রবিবার (২২ জুন) দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় পাইকারি চালের আড়ত বাহাদুরবাজারে গিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে মিনিকেট চালের ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৭০০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছিল তিন হাজার ২০০ টাকায়। একইভাবে দুই হাজার ৫৫০ টাকার বিআর উনত্রিশ দুই হাজার ৯০০, দুই হাজার ৭০০ টাকার আঠাশ তিন হাজার ২০০, দুই হাজার ৭০০ টাকার সুমন স্বর্ণা দুই হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সদ্য বাজারে উঠা শম্পা কাটারি বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৪০০ টাকায়। আর একই জাতের পুরাতন চাল বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৮০০ টাকায়। যা এক সপ্তাহ আগেও ৫০০ টাকা কমে বস্তা বিক্রি হয়েছিল। এটি পাইকারি হিসাব। পাইকারিতে বাড়ায় খুচরা পর্যায়েও প্রতি কেজিতে তিন থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আঠাশ ও মিনিকেটের দাম। 

খুচরায় মিনিকেটের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯২ থেকে ৯৫, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৮২ থেকে ৮৫ টাকা। উনত্রিশ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৩ থেকে ৭৪ টাকায়, যা ছিল ৬৩ থেকে ৬৪ টাকা, আঠাশ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়, যা ছিল ৬৮ থেকে ৭০ টাকা, সুমন স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৪ টাকা, যা ছিল ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। পুরাতন শম্পা কাটারি বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ৯৬ টাকায় আর নতুন ৮৫ থেকে ৮৬ টাকায়।

ক্রেতাদের ক্ষোভ

ধানের মৌসুমে চালের এমন ঊর্ধ্বগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। শহরের রামনগর এলাকার মজিবর রহমান চাল কিনতে এসে বলেন, ‘ধান বেচতে গেলে দাম কম। চাল কিনতে গেলে দাম বেশি। আজকে একরকম দাম, কাল আরেক রকম। দুই হাজার ৪০০ টাকার সুমন স্বর্ণা এখন দুই হাজার ৮০০ টাকা। এগুলো ব্যবসায়ীদের কারসাজি, মিলারদের কারসাজি। পুতুলের মতো নাচাচ্ছে। দেখার যেন কেউ নেই।’

সদরের চেহেলগাজি এলাকার বশির উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি মোটা চাল কিনতে এসেছি। কিন্তু এই চাল বাজারে নেই। সুমন স্বর্ণা ঈদের আগে কিনেছি দুই হাজার ৬০০ টাকা বস্তা। এখন দুই হাজার ৮০০ টাকা। আর তিন হাজার ২০০ টাকার মিনিকেট তিন হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমি দিনমজুর। আমার তো আর হাজিরা বাড়েনি। কেজিতে ১০ টাকা বাড়লে আমাদের তো না খেয়ে থাকতে হবে।’ 

একই কথা বলেছেন শহরের অটোরিকশাচালক সেলিম মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমার আয় বাড়েনি। কিন্তু চালের দাম বেড়েছে। দাম শুধু বাড়তেই দেখি, কমতে দেখি না। ধানের মৌসুমেও কমে না, অন্য সময়েও না। সংকট থাকলে দাম বাড়বে, কিন্তু যখন ধান উঠে তখন তো কমার কথা। অথচ যখন-তখন বাড়ে। ৭৫ টাকার চাল ৮০ টাকায় কিনলে আমরা অন্য জিনিসপত্র কীভাবে কিনবো, সংসারই বা কীভাবে চালাবো।’

চালকল মালিকদের দুষছেন ব্যবসায়ীরা

ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাসখানেক হলো বাজারে নতুন মৌসুমের বোরো ধান এসেছে। এই ধান থেকে তৈরি চাল গত মাসেই বাজারে আসে। তাতে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মিনিকেটের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা কমেছিল। অনেকটা সেই দামেই ১০ জুন পর্যন্ত চাল বিক্রি হয়েছিল। এরপর হঠাৎ বোরো ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত সপ্তাহ থেকে মিনিকেট চালের দামও বাড়িয়ে দেন চালকল মালিকরা।

বাহাদুরবাজারের শহীদ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী শহীদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোরবানির ঠিক কয়েকদিন পর থেকে প্রতি বস্তায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন চালকল মালিকরা। তারা বলছেন ধানের দাম বেশি, এজন্য চালের দাম বাড়িয়েছেন। ফলে আমাদের বেশি দামে কিনে কিছুটা লাভ রেখে বিক্রি করতে হয়। সাধারণ মানুষকে বেশি দামে চাল কিনে খেতে হচ্ছে। মূলত গত ১০ দিন ধরে এ অবস্থা চলছে। এতে বিক্রি কমেছে। আমরাও বিপাকে পড়েছি।’

সুফি রাইসের স্বত্বাধিকারী জাহিদ কামাল জাভেদ বলেন, ‘গত ১০ দিন ধরে চালের দাম বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন চালকল মালিকরা দাম বাড়িয়েছেন। চালকল মালিকরা বলছেন ধানের দাম বেশি। আমি কারও দোষ দেবো না। তবে এইটুকু জানি, আবহাওয়া ভালো হওয়ায় সবাই নতুন ধান কিনে মজুত করেছেন। এজন্য ধানের দাম বেশি। আর বাজারে বস্তায় যেভাবে দাম বেড়েছে তার কারণ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছে টাকা আছে, মজুত করে দাম বাড়িয়েছেন। চালকল মালিক ছাড়া যারা ধান মজুত করেছেন তাদের কারণে দাম বেড়েছে। আমরা যে দামে মিলারদের থেকে কিনছি, তার চেয়ে কিছুটা লাভ রেখে বিক্রি করে দিচ্ছি।’

বাহাদুরবাজার থেকে চাল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এক ভ্যানচালক

খাদ্য ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী আলাল হোসেন বলেন, ‘নতুন চাল বাজারে এলেই দু’চার দিনের মধ্যে বিক্রি করে দিই। গত ১০ দিনের ব্যবধানে প্রতি বস্তায় বেড়েছে ৫০০ টাকা। বোরো আবাদ দিয়ে আমাদের আট থেকে নয় মাস চলে। কিন্তু এখন মৌসুমের শুরুতে যে দাম, তাতে সামনে কী হবে তা ভাবছি। সরকার ও প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে বাজারের এ অবস্থা। অভিযান চালিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’

চালকল মালিকদের দাবি, ধানের দাম বেশি 

বাংলাদেশ অটো, মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ধানের দাম বাড়লে চালের দামও বাড়ে। ধানের দাম বাড়ুক এটা আমরা চাই, এতে কৃষকরা লাভবান হবেন। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে দাম বেড়েছে এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন না। কারণ অধিকাংশ কৃষকের ঘরে এখন ধান নেই। এক শ্রেণির অসাধু মজুতদার ধান কিনে এখন বেশি দামে বিক্রি করছেন। ফলে ধানের দাম বাড়ছে, সেইসঙ্গ বাড়ছে চালেরও। চালের দাম বাড়লে আমাদের দায়ী করা হয়। আমরা চাই এর জন্য অভিযান চালানো হোক। যারা অবৈধভাবে ধান মজুত করে মিলারদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। জেলায় ছোট-বড় অনেক মজুতদার রয়েছেন। তারা সবাই লাইসেন্সের আওতায় আসেনি। এসব মজুতদারই মূলত সিন্ডিকেট করে ধানের দাম বাড়াচ্ছেন। অবৈধ মজুতদারদের আইনের আওতায় আনলেই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আর যদি তাদের নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে তারা আগামী দুই মাসে ধানের দাম বাড়ালে চালের দাম আরও বেড়ে যাবে।’ 

মৌসুমের শুরুতে নওগাঁয় অস্থির চালের বাজার

নওগাঁ জেলায় বোরোর মৌসুম শেষ হয়েছে মাসখানেক হলো। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ফসল ভালো হয়েছে। তারপরও মৌসুমের শুরুতে জেলায় অস্থির চালের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত। এতে খুচরা বাজারেও কেজিতে বেড়েছে ছয়-সাত টাকা। হঠাৎ দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষজন।

ক্রেতারা বলছেন, ধানের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সুযোগ বুঝে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন চালকল মালিকরা। কিছু ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক ধান সংগ্রহ করে মজুত করেছেন। কৃষকের হাত থেকে ধান চলে যাওয়ার পরই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে এ নিয়ে প্রশাসনের নজরদারি নেই। তারা অভিযান চালাচ্ছে না।

জেলার সবচেয়ে বড় চালের মোকাম শহরের আলুপট্টি চাল বাজারে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি কেজি চালের দাম চার-পাঁচ টাকা বেড়ে জিরাশাইল ৬৮-৭০ টাকা, শুভলতা ৬০-৬২ টাকা, কাটারি ৭০-৭২, ব্রি আর-২৮ ৬২-৬৪ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫৫-৫৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও জিরাশাইল ৬৪-৬৬ টাকা, কাটারি ৬৬-৬৮ টাকা, শুভলতা ৫৭-৫৮ টাকা, ব্রি আর-২৮ জাতের চাল ৫৯-৬০ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ চাল ৫৩-৫৪ টাকা করে বিক্রি হয়েছিল।

নওগাঁ পৌর ক্ষুদ্র চাল বাজারে দেখা যায়, বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে মানভেদে কেজি প্রতি পাঁচ-ছয় টাকা বেড়ে জিরাশাইল ৭০-৭২ টাকা, কাটারি ৭৫-৮০ টাকা, শুভলতা ৬২-৬৪ টাকা, ব্রি আর-২৮ চাল ৬৫-৬৬ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫৮-৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে জিরাশাইল ৬৫-৬৬ টাকা, কাটারি ৭০-৭২ টাকা, শুভলতা ৫৭-৫৮ টাকা, ব্রি আর-২৮ চাল ৫৯-৬০ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫২-৫৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

নওগাঁ পৌর ক্ষুদ্র চাল বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা

পৌর ক্ষুদ্র চাল বাজার সমিতির সভাপতি মকবুল হোসেন বলেন, ‘বড় বড় ব্যবসায়ীরা বেশি দাম দিয়ে ধান কিনছেন। ছোট ব্যবসায়ীরা বড় বড় মিলারদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না। এটা পুরো একটা সিন্ডিকেট। বাংলাদেশে যে ধান আছে, তা দিয়ে এক বছর চলে যাবে। সরকারি নজরদারি না থাকার সুযোগে কৃত্রিমভাবে মজুত করেছেন তারা। তাই বাজারে চালের দাম বেড়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে দ্রুত অভিযান চালাতে হবে।’

নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘চালের দাম সাধারণত দুই-তিন টাকা বেড়েছে। আর ছয় টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে ব্র্যান্ডিং কোম্পানির। তবে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে কৃষকদের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে। যার কারণে চালের দাম বেড়েছে। তারপরও আমরা বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ চাই। এজন্য আমাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। আর দৃশ্যমানভাবে যেসব মিলে অতিরিক্ত মজুত আছে সেখানে অভিযান চালনো উচিত। বাজারে স্বস্তি ফেরাতে চাইলে ধান-চালের অবৈধ মজুতদারদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে ওএমএস কর্মসূচি সচল রাখা হয়েছে। অবৈধ মজুতদারদের খুঁজে বের করতে জেলার বিভিন্ন মিল পরিদর্শন করা হচ্ছে। কোথাও অবৈধ মজুত পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘চালের দাম কী কারণে বেড়েছে, তা জানতে জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা যেন প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করেন। অনুসন্ধানে যদি অপরাধ মনে হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই অভিযান পরিচালনা করবো।’

Source link

Related posts

মোংলায় শুরু হলো শীতের পিঠা উৎসব

News Desk

কুষ্টিয়া ২৪ ঘণ্টায় করোনা ইউনিটে আরও ৮ জনের মৃত্যু

News Desk

অটোরিকশা ছিনতাইয়ের পর চালককে পুকুরে ফেলে হত্যা, গ্রেফতার ৫

News Desk

Leave a Comment