ঘুষ ছাড়া সার দেন না শওকত, সরকারি কার্যালয়ে বানিয়েছেন বিশ্রামকক্ষ
বাংলাদেশ

ঘুষ ছাড়া সার দেন না শওকত, সরকারি কার্যালয়ে বানিয়েছেন বিশ্রামকক্ষ

ঘুষ ছাড়া ডিলারদের নামে সার বরাদ্দ দেন না বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) দিনাজপুর অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক (সার) শওকত আলী। কোনও ডিলার ঘুষ না দিলে তাদের হয়রানি করা হয়। আবার গুদামে সার ঢোকানো ও বের করার সময় শ্রমিকদের বিল থেকেও শওকতকে ঘুষ দিতে হয়। না দিলে সংশ্লিষ্ট গুদামে সার সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এভাবে দুর্নীতি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী সার ডিলাররা গত ২ নভেম্বর বিএডিসির চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

পাশাপাশি নিজ কার্যালয়ে আলাদা বিশ্রামকক্ষ দিয়েছেন শওকত আলী। বিশ্রামকক্ষে শুয়েবসে অফিস করছেন তিনি। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে সরেজমিনে তার কার্যালয়ে গিয়ে বিশ্রামকক্ষ দেখা গেছে। 

ভুক্তভোগী সার ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শওকত আলী যোগদানের পর থেকেই কোনও নীতিমালার তোয়াক্কা করেন না। প্রয়োজন ছাড়াই ডিলারদের সার উত্তোলনের ডিও লেটারে (আবেদনপত্র) স্বাক্ষর করার নামে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছেন। প্রকাশ্যে ঘুষ নিচ্ছেন। ঘুষ না দিলে ডিলারদের কাছের গুদামে সার থাকলেও সেখান থেকে না দিয়ে দূরের গুদাম থেকে সার বরাদ্দ করেন। এতে করে ডিলারদের সার পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। দুর্ভোগ এড়াতে তাকে ঘুষ দিলে তাৎক্ষণিক সেই আদেশ বাতিল করে কাছের গুদাম থেকে সার বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। বেশিরভাগ সময় শুয়েবসে অফিস করেন। এসবের প্রতিবাদ করলে গালিগালাজ করা, লাইসেন্স বাতিলসহ নানাভাবে হয়রানির হুমকি দেন ডিলারদের।

ডিলারদের অভিযোগ, প্রতিবার সার উত্তোলনের সময় তাদের কাছ থেকে প্রতি বস্তা তিউনেসিয়া টিএসপি সারের জন্য ৮০ থেকে ১০০, চায়না ডিএপি সারে ৬০ থেকে ৮০ এবং কানাডা এমওপি সারের জন্য ২০ টাকা করে বাধ্যতামূলকভাবে ঘুষ নেওয়া হয়। না দিলে চাহিদামতো সার দেওয়া হয় না ডিলারদের। এমন সাতটি অভিযোগ সংযুক্ত করে ২ নভেম্বর বিএডিসির চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ডিলাররা।

দিনাজপুর বিএডিসি বীজ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মির্জা লিয়াকত আলী বেগ ও সাধারণ সম্পাদক ওয়াহেদ আলী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সার উত্তোলনের দরখাস্তে স্বাক্ষর করার নামে বিভিন্নভাবে ডিলারদের হয়রানি করেন শওকত আলী। অথচ দরখাস্তে স্বাক্ষর করার মূল দায়িত্ব সহকারী পরিচালকের। এজন্য ঘুষ না দিলে ডিলারদের সঙ্গে খারাপ আচরণ ও লাইসেন্স বাতিলের ভয়ভীতি দেখান তিনি। এ ছাড়া বিভিন্ন অজুহাতে ঘুষ নেন। না দিলে ডিলারদের নিকটবর্তী সার গোডাউনে থাকা সত্ত্বেও দূরবর্তী গোডাউন থেকে বরাদ্দ দেন। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। পাশাপাশি গুদামে সার ঢোকানো ও বের করার সময় শ্রমিকদের বিল থেকেও শওকতকে টাকা দিতে হয়। না হলে সংশ্লিষ্ট গুদামে সার সরবরাহ বন্ধ করে দেন। আবার সিজন শেষে সার পুনর্গণনা করার সময় নিজস্ব ঠিকাদারের মাধ্যমে ভুয়া কোটেশন ও বিল তৈরি করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। ঘুষ না দেওয়ায় ইতিপূর্বে বিভিন্ন গোডাউনে সার সরবরাহ কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিলেন। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে ঘুষ দেন ডিলাররা। এ অবস্থার নিরসন জরুরি।

শুধু ডিলারদের সঙ্গেই নয়, শওকত আলীর বিরুদ্ধে তার অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও নানাভাবে হয়রানি ও অশোভন আচরণের অভিযোগ রয়েছে। তিনি বহিরাগতদের সামনেই তাদের বিভিন্ন অজুহাতে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে থাকেন। রয়েছে অফিসে ধূমপানসহ মাদকসেবনের অভিযোগও।

শওকত আলী

এ বিষয়ে বিএডিসির বীজ ও সার ডিলার আহসান হাবিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সার তুলতে গেলেই শওকত আলীকে ঘুষ দিতে হয়। বস্তাপ্রতি তিনি যেভাবে ঘুষের টাকা নিয়ে দরাদরি করেন, তাতে মনে হয় বিএডিসি তার কোম্পানি। তার কারণে আমরা ভোগান্তিতে আছি। ডিওতে স্বাক্ষর করার নামে ঘুষ না দিলে হয়রানি করেন। দূরবর্তী গোডাউন থেকে সার নিতে বাধ্য করেন। কৃষক পর্যায়ে চাহিদা আছে এমন সার নিতে গেলে বেশি টাকা দিতে হয়। না দিলে ওই সার দেওয়া হয় না, অন্য সার দেয়। তিনি এ পর্যন্ত যে ঘুষ নিয়েছেন, তার তথ্য-প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। তার বিকাশ-নগদ নম্বরেও তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। এসব কারণে আমরা অভিযোগ দিয়েছি। চেয়ার‌ম্যান অভিযোগ গ্রহণ করলেও এখনও কোনও জবাব দেননি।’

জেলা শহরের আরেক ডিলার আব্দুল বাতেন বলেন, ‘আমাকে সার দেওয়ার কথা পুলহাট, নশিপুর কিংবা কাঞ্চন গোডাউন থেকে। কিন্তু দেওয়া হয়েছে বিরামপুর গোডাউন থেকে। সেখান থেকে সার আনতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। উনি কিছু টাকা চেয়েছিলেন, দিতে পারি নাই। এজন্য এমন করেছেন। আমি যদি বাড়তি টাকাটা দিতাম তাহলে পুলহাট কিংবা নশিপুর থেকেই সার দিতেন তিনি।’

পুলহাট সার গোডাউনের শ্রমিক সরদার করিমুল হক বাচ্চু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের গোডাউনে সার দিচ্ছেন না শওকত আলী। ওনাকে টাকা দিলে সার দেবে, না দিলে দেবে না বলে আমাকে জানিয়েছেন। এর আগে যতবার টাকা দিয়েছি, ততবার সার দিয়েছেন। সরকার পরিবর্তন হওয়ায় এবার দিতে রাজি হইনি, ভাবলাম হয়তো এবার তিনি ভালো হয়ে গেছেন। কিন্তু না। টাকা না পাওয়ায় ঠিকই সার দিলেন না।’

সার ডিলার আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘এভাবে ‍ঘুষ নেওয়ার কারণে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কৃষকদের কাছে আমাদেরকে সার বিক্রি করতে হচ্ছে। মাসের পর মাস তাকে ঘুষ দিয়ে আসছি আমরা।’

সদরের করিমুল্লাপুর এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি দামের চেয়ে ৩০০-৪০০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে হয় আমাদের। এরপরও বলা হয় সার নেই। আবার টাকা বাড়িয়ে দিলে ঠিকই দেওয়া হয়।’

ঘুঘুডাঙ্গা এলাকার কৃষক মোখলেসার রহমান বলেন, ‘এখন সার পাওয়া যাচ্ছে না। ডিলাররা বলছেন, সরবরাহ নেই। যার কারণে আমরা পড়েছি সমস্যায়। এখন আবাদের মৌসুম। সার না পেলে আবাদ করা যাবে না।’

গৌরিপুর এলাকার কৃষক সালেউর রহমান বলেন, ‘ডিলাররা বলছেন, সার নেই। এ সুযোগে খুচরা দোকানদাররাও বলছেন সার সংকট। প্রতি বস্তায় ৪০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছে। সারের সমস্যা সরকার দেখলে কৃষকদের উপকার হতো। অথবা কার্ড সিস্টেম করে সার দিলেও হতো।’

কৃষি মৌসুমে ন্যায্য মূল্যে সার পাচ্ছেন না কৃষকরা

তবে এটিকে সারের কৃত্রিম সংকট বলে জানালেন দিনাজপুরের কৃষি উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র সার বিক্রেতা ফরিদুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এখন আলুসহ বিভিন্ন ফসলের মৌসুম চলছে। সারের চাহিদা প্রচুর। এ সুযোগে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। ডিলারদের কাছে গেলে ন্যায্যমূল্যে পাচ্ছি না। টিএসপি সার ১৩৫০ টাকার স্থলে ১৭৫০, পটাশ (এমওপি) ১০০০ টাকার স্থলে ১১৪০, ড্যাপ (ডিএপি) ১০৫০ টাকার স্থলে ১১৮০ টাকায় কিনতে হয়। দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের চাষাবাদ করতে ব্যাঘাত ঘটছে।’

বিএডিসির বীজ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মির্জা লিয়াকত আলী বেগ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শওকত আলী প্রত্যেক ডিলারের কাছ থেকে ঘুষ নেন। আমরা নিজস্ব টিম দিয়ে তদন্ত করে এর প্রমাণ পেয়েছি। দেশ সংস্কারের পথে, অথচ এই অসৎ লোক এখনও ভালো হয়নি। তার কারণে কৃষকরা ন্যায্যমূল্যে সার পান না, যথাসময়ে সার দিতে পারি না। এজন্য বিএডিসি চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যবস্থা না দিলে আমরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবো।’

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বিএডিসির দিনাজপুর অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক শওকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখান থেকে ডিও কাটা হয়। কোনও ঘুষ নেওয়া হয় না। আমার অফিসের স্টাফদের জিজ্ঞাসা করেন, যদি কেউ আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ দিতে পারে আমি চাকরি ছেড়ে দেবো। ৬৭৫ জন ডিলারকে পাস বই দেওয়া হয়েছে। ঠিকমতো সবার মাঝে সার বণ্টন করা হয়। যেসব গোডাউনে সার আছে সেখান থেকে সমন্বয় করে ডিলারদের সরবরাহ করা হয়। কাউকে দূরে পাঠিয়ে হয়রানি করা হয় না।’

শ্রমিকদের বিল থেকে ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখানে শ্রমিক সরদার করিমুল হক বাচ্চু। তিনি যদি আমার সামনে বলতে পারেন কমিশন থেকে টাকা কাটি। তাহলে যে শাস্তি দেওয়া হবে, আমি মেনে নেবো।’ 

শ্রমিকরা সার ন্যায্যমূল্যে পান না, বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন, এ ব্যাপারে শওকত আলী বলেন, ‘এটি মনিটরিং করার দায়িত্ব আমার নয়।’ 

কার্যালয়ে বিশ্রামকক্ষ

শওকত আলীর কার্যালয়ে গিয়ে আলাদা একটি বিশ্রামকক্ষ দেখা গেছে। নিজ অফিস কক্ষের পাশেই এটি। সেখানে একটি ডাবল খাট, ফ্যান, সোফা, টেবিল ও বাথরুম রয়েছে। 

শওকত আলীর কার্যালয়ে আলাদা বিশ্রামকক্ষ

এ বিষয়ে শওকত আলী বলেন, ‌‘এটি স্পেশাল কিছু না। পুরাতন গোডাউন। সেটাকে বিশ্রামকক্ষ করা হয়েছে। শুভ কাজ ছাড়া এখানে অন্য কিছু হয় না। চা-কফি খাওয়ার জন্য ব্যবহার করি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) দিনাজপুর অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক (সার) পদে যোগ দেন শওকত আলী। 

প্রতি বছরে তার অধীনে থাকা তিনটি জেলা দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে কী পরিমাণ সার বরাদ্দ হয় তার একটা তালিকা চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি এখন আমার কাছে নেই। পরে দেবো।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে বিএডিসির চেয়ারম্যান রুহুল আমিন খানের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামানের মোবাইলে কল দিয়ে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়। আর সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. আজিম উদ্দিনের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও ধরেননি।

Source link

Related posts

সাজেক ভ্রমণে ২ দিনের নিষেধাজ্ঞা

News Desk

আগামীকাল থেকে ফাইজারের টিকা প্রদান শুরু

News Desk

বাস ছেড়ে ৩০ কিমি হেঁটে সমাবেশস্থলে নেতা-কর্মীরা

News Desk

Leave a Comment