Image default
খেলা

সাকিব আল হাসান: সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার

২০০৬ সালের ৬ আগস্ট! বাংলাদেশের আকাশে নতুন এক নক্ষত্রের জন্ম। এদিনই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র রঙিন পোশাকে অভিষেক। জিম্বাবুয়ের হারারেতে সেদিন শুরু এরপর কতশত রেকর্ড ভেঙেছেন আর কতশত রেকর্ড নিজের করে সৃষ্টি করেছেন তার নেই ইয়োত্তা। বলছিলাম সাকিব আল হাসানের কথা। দীর্ঘ ১৫ বছরের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে ছাড়িয়ে গেছেন বিশ্বের বড় বড় তারকাদের। এখন তার লড়াই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার।

সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার দৌড়েও নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন সাকিব। এবার ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ভারতীয় কলামিস্ট অনন্ত নারায়ন এক বিশ্লেষণধর্মী লেখনিতে সাকিব আল হাসানকে ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোকালের সেরা অলরাউন্ডারের উপাধি দিয়েছেন।

উপাদান সূচক, ভিত্তি মান ও রেটিং মানের ভিত্তিতে সাকিবকে ওয়ানডের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি। ওয়ানডেতে শীর্ষে থাকলেও নারায়নের তালিকায় টেস্টে দুই নম্বরে জায়গা পেয়েছেন সাকিব।

সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের তালিকা করতে অনন্ত ক্রিকেটারদের ব্যাটিং গড়, ব্যাটিং স্ট্রাইক রেট, বোলিং স্ট্রাইক রেট, বোলিং অ্যাকুরেসি, দলে অবদান, ধারাবাহিকতা, গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টে ব্যাটিং-বোলিং, ম্যাচ সেরা পারফরম্যান্স, ওয়ানডেতে প্রতি ম্যাচে গড় পারফরম্যান্স, ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। যেখানে প্রতিটি ক্যাটাগরির জন্য আলাদা আলাদা পয়েন্ট ব্যবহার করেছেন তিনি।

গড় সবসময়ই একজন ব্যাটারের রান করার সক্ষমতা প্রমাণ করে। যেখানে অনন্ত ব্যাটিং গড়ের জন্য রেখেছেন ১২৫ পয়েন্ট। যে ব্যাটারদের ব্যাটিং গড় ৫০, তারাই পাবেন পুরো পয়েন্ট। তবে যাদের গড় ৫০ এর নিচে যথারীতি তারা পাবেন এর থেকে কম পয়েন্ট।

ক্রিকেটারদের স্ট্রাইক রেটের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হবে ১২৫ পয়েন্ট। বোলিং স্ট্রাইক রেটের জন্য বোলাররা পাবেন সমান পয়েন্ট। সেক্ষেত্রে বোলারদের স্ট্রাইক রেট হতে হবে ৩০। বোলিং অ্যাকুরেসির জন্যও থাকছে একই পয়েন্ট। ওভার প্রতি ৩.৫ রান দিয়েছেন, এমন বোলাররাই পাবেন পুরো ১২৫ পয়েন্ট। এর চেয়ে কমবেশি হলে উঠানামা হবে পয়েন্টও।

দলের জয় পরাজয়ে অবদান এবং ধারাবাহিকতার জন্যও ক্রিকেটারদের পয়েন্ট দিয়েছেন নারায়ন। এদিক বিবেচনায় তিনি ক্রিকেটারদের পয়েন্ট দিয়েছেন ১২৫। বড় টুর্নামেন্টে ব্যাটিং, বোলিং, ম্যাচ সেরা পারফরম্যান্স, ওয়ানডেতে প্রতি ম্যাচে গড় পারফরম্যান্স, ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্যের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ পয়েন্ট করে।

ভারতীয় এই ক্রিকেট বোদ্ধার বিশ্লেষণে সাকিব আল হাসান পেয়েছেন ৭৩৮ পয়েন্ট। তালিকার দুইয়ে থাকা ইংলিশ অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রিউ ফ্লিনটফ পেয়েছেন ৬৯১ পয়েন্ট। সর্বকালের সেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডারদের তালিকায় জ্যাক ক্যালিস তিনে, স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস চারে এবং পাঁচে জায়গা পেয়েছেন শেন ওয়াটসন।

ওয়ানডেতে সব কিংবদন্তিদের পেছনে ফেলতে পারলেও টেস্টে স্যার গ্যারি সোবার্সের পেছনেই থাকতে হচ্ছে সাকিবকে। তবে এই তালিকায় দুইয়ে জায়গা করে নেওয়া সাকিব ঠিকই কিংবদন্তি ইমরান খান, ইয়ান বোথাম এবং স্যার রিচার্ড হ্যাডলিকেও পেছনে ফেলেছেন। অনন্তের তালিকায় টেস্টে সাকিব দ্বিতীয় সেরা অলরাউন্ডার হলেও তার প্রশংসায় সাকিবকে ভাসিয়েছেন তিনি।

সাকিব প্রসঙ্গে অনন্ত বলেন, ‘সাকিব প্রমাণ করেছে, টেস্ট অলরাউন্ডারদের তালিকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় স্থানে থাকাটা আকস্মিক কোনো সাফল্য নয়। সে এখন বিভিন্ন ফরম্যাটে শীর্ষ অলরাউন্ডার। ওয়ানডেতে বিশাল ব্যবধানে র‍্যাংকিংয়ে এক নম্বরে অবস্থান করছে।’

ভারতীয় এই কলামিস্ট আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞার জন্য সে হয়ত অনেক উঁচুতে থেকে শেষ করেছিল। তবে সে আগের মতোই দুর্দান্তভাবে ফিরে এসেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে তার পারফরম্যান্স অনবদ্য।

সাকিব আল হাসান (জন্ম: ২৪ মার্চ ১৯৮৭) একজন বাংলাদেশী ক্রিকেটার। তিনি বামহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং বামহাতি অর্থোডক্স স্পিনার। তিনি ২৮ অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের টেস্ট ও টি২০ আন্তর্জাতিক সংস্করণে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের হয়ে খেলা সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচিত সাকিবকে বিশ্বের অন্যতম সেরা অল-রাউন্ডার বলে গণ্য করা হয়। ১০ বছর ধরে শীর্ষ অল-রাউন্ডার এর রেকর্ডের অধিকারী সাকিব এখনো একদিনের আন্তর্জাতিক ও টেস্ট ফরম্যাটে সর্বোচ্চ র‍্যাংকিং ধরে রেখেছেন।

২০০৬ সালের আগস্ট মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার অভিষেক হয়। সাকিব বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)- এর একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। সাকিব ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইসিসির খেলোয়াড়দের র‍্যাংকিং অনুসারে টেস্ট, ওডিআই ও টি২০ প্রত্যেক ক্রিকেট সংস্করণে প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে এক নম্বর অল-রাউন্ডার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে একদিনের ক্রিকেটে ৪,০০০ করার গৌরব অর্জন করেন এবং ২০১৭ সালের ১৩ই জানুয়ারি টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান (২১৭) সংগ্রাহক হন। তিনি টি২০তে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০০০ রান পূর্ণ করেন ৷ এছাড়া দ্বিতীয় অলরাউন্ডার হিসেবে টি২০তে ১০০০ রান ও ৫০ উইকেট লাভ করেন। ২০১৯ সালের জুনে তিনি দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে মাত্র ১৯৯ ম্যাচে ৫,০০০ রান ও ২৫০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন।

সাকিব আল হাসান বিশ্বসেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডারের মধ্যে একজন, যিনি একই সাথে দীর্ঘদিন তিন ফরমেটের (টেস্ট, ওয়ান-ডে, টি-২০) ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ, নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার হিসাবে ছিলেন। ক্রিকেট ইতিহাসে এমন রেকর্ড শুধুমাত্র সাকিবের।

প্রারম্ভিক জীবন ও যুব ক্রিকেট
সাকিব আল হাসান ১৯৮৭ সালের ২৩শে মার্চ মাগুরায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাশরুর রেজা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং মাতা শিরিন শারমিন একজন গৃহিণী। তরুণ বয়সেই সাকিব খেলাপাগল ছিলেন। তার বাবা খুলনা বিভাগের হয়ে এবং এক কাজিন বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলতেন। দৈনিক প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র’র বর্ণনা অনুসারে, “সাকিবের ক্রিকেট দক্ষতা ছিল অসাধারণ এবং গ্রাম-গ্রামান্তরে তাকে খেলার জন্য ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হত। এরকমই এক ম্যাচে সাকিব এক আম্পায়ারকে অভিভূত করেছিলেন যিনি পরবর্তীতে সাকিবকে ইসলামপুর পাড়া ক্লাব (মাগুরা ক্রিকেট লীগের একটি দল) এর সাথে অনুশীলন করার সুযোগ করে দেন। সাকিব তার স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং ও দ্রুতগতির বোলিং অব্যাহত রাখেন, সেই সাথে প্রথমবারের মত স্পিন বোলিং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন ও সফল হন। ফলস্বরূপ, ইসলামপুর দলে খেলার সুযোগ পান এবং প্রথম বলেই উইকেট তুলে নেন। সত্যিকারের ক্রিকেট বল দিয়ে এটাই ছিল তার প্রথম করা বল, এর আগ পর্যন্ত তিনি টেপড টেনিস বল দিয়েই খেলতেন। তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ছয়মাস প্রশিক্ষণ নেন এবং ২০০৪ সালে ১৭ বছর বয়সে জাতীয় লীগে খেলার জন্য খুলনা দলে নাম জমা দেন।

মাত্র পনের বছর বয়সেই সাকিব অনূর্ধ্ব​-১৯ দলে খেলার সুযোগ পান। ২০০৫ সালে অনূর্ধ্ব​-১৯ ত্রি-দেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে (অপর দুটি দেশ ছিল ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা) মাত্র ৮৬ বলে সেঞ্চুরি করে ও তিনটি উইকেট নিয়ে দলকে জেতাতে সহায়তা করেন তিনি। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সাকিব অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ১৮টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। ৩৫.১৮ গড়ে তিনি মোট ৫৬৩ রান সংগ্রহ করেন এবং ২০.১৮ গড়ে নেন মোট ২২টি উইকেট।

অভিষেকের বছরগুলো
২০০৬ সালের জিম্বাবুয়ে সফরে সাকিব প্রথমবারের মত বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান। একই ট্যুরে ওয়ানডে অভিষেক হয় ফরহাদ রেজা ও মুশফিকুর রহিমের। সাকিব ও রেজাকে তখন “দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রতিভা” হিসেবে গণ্য করা হত, সকল ডিপার্টমেন্টে যাদের দক্ষতা অসামান্য। তৎকালীন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য: “তরুণদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। এখনই সময় তাদের আন্তর্জাতিক লেভেলে খেলার সুযোগ করে দেয়া।” একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় সাকিবের অভিষেক হয় ৬ই আগস্ট। তার প্রথম শিকার হন এলটন চিগুম্বুরা। ৩৯-১, এই ছিল তার সেদিনকার বোলিং ফিগার। ব্যাট হাতে তিনি ৩০ বলে ৩০ রান করে অপরাজিত থাকেন। শাহরিয়ার নাফিস সেদিন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতাতে ভূমিকা রাখেন। ম্যাচটি ছিল সিরিজের শেষ ম্যাচ যাতে জিম্বাবুয়ে ৩-২ ব্যবধানে জয়ী হয়। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে সাকিব, ফরহাদ রেজা ও মেহরাব হোসেন জুনিয়র বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। ফলে, বোর্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়ের সংখ্যা ২০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ এ।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ আয়োজিত ‘২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপ’ এ হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন ১৫ জনের বাংলাদেশ স্কোয়াডে ডাক পান এই তরুণ ক্রিকেটার।
টুর্নামেন্টের দ্বিতীর পর্বে যেতে সক্ষম হয় এই দল এবং ৭ নম্বর টিম হিসেবে টুর্নামেন্ট শেষ করে। শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে দলটি বড়সড় রকমের অঘটনের জন্ম দেয়। তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও সাকিব – এ তিনজনের হাফ সেঞ্চুরির উপর ভর করে বাংলাদেশ সহজেই ১৯২ রানের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে যায়। টুর্নামেন্টে সাকিব ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আরেকটি হাফ সেঞ্চুরি করেন। ৯ ম্যাচে তিনি ২৮.৮৫ গড়ে ২০২ রান করেন। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেন মোহাম্মদ আশরাফুল (২১৬)। সাকিব ৪৩.১৪ গড়ে ৭টি উইকেটও নেন।

সে বছরই মে মাসে দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডে’র এক সফরে ভারত বাংলাদেশে আসে। মে মাসের ১৮ তারিখ সাকিবের টেস্ট অভিষেক হয় ভারতের বিপক্ষে। অভিষেকটা ঠিক স্বপ্নের মত হয়নি তার জন্য। এক ইনিংস ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে এই অলরাউন্ডার ২৭ রান করেন এবং ১৩ ওভার বল করে উইকেটশূণ্য অবস্থায় থাকেন। ম্যাচটি ড্র হয়। ভারত টেস্ট সিরিজ জেতে ১-০ ব্যবধানে এবং ওয়ানডে সিরিজ ৩-০ তে। সিরিজ শেষে ডেভ হোয়াটমোর দলের কোচের দায়িত্ব ছেড়ে দেন এবং হাবিবুল বাশারের স্থলাভিষিক্ত হন মোহাম্মদ আশরাফুল। সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়োজিত আইসিসি টুয়েন্টি২০ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে জয়ের সুবাদে বাংলাদেশ দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার সুযোগ পায়। ম্যাচটিতে সাকিব ৩৪ রানে নেন ৪ উইকেট। সাকিবই প্রথম বাংলাদেশী যিনি টি-২০ ফরম্যাটে ৩টির বেশি উইকেট নেয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। অক্টোবর মাসে ঘোষণা করা হয় যে, জেমি সিডন্স, অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন সহকারী কোচ, বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিতে আসছেন। সিডন্স বাংলাদেশের উন্নতিকল্পে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেন এবং প্রতিভাবান তরুণদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশি বেশি সুযোগ দেবার ঘোষণা দেন।

২০০৭-এর ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ দল দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডে খেলতে নিউজিল্যান্ড আসে। প্রথম টেস্টে খেলার সুযোগ না পেলেও পরের টেস্টেই সাকিব এনামুল হক জুনিয়রকে রিপ্লেস করেন তার ব্যাটিং কোয়ালিটির জন্য। এটা ছিল সাকিবের চতুর্থ টেস্ট। তখন পর্যন্ত সাকিব টেস্টে উইকেটশূন্য ছিলেন। সাকিবের প্রথম টেস্ট শিকার হন নিউজিল্যান্ডের ক্রেইগ কামিং। নিউজিল্যান্ড জেতে এক ইনিংস ও ১৩৭ রানে। ওয়ানডে সিরিজেও নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করে। তিন ম্যাচে সাকিব ১০.৩৩ গড়ে ৩১ রান করেন এবং ৪২.৩৩ গড়ে তিনটি উইকেট নেন। ২০০৮ এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডে খেলার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ সফরে আসে। দুটো টেস্টেই সফরকারী দল জয়লাভ করে। সাকিব ১২২ রান দিয়ে মাত্র একটি উইকেট নেন এবং ব্যাট হাতে ৭৫ রান করেন। ওয়ানডে সিরিজেও দক্ষিণ আফ্রিকা ৩-০ তে জয় পায়। এ সিরিজেই সাকিব ওয়ানডেতে ১০০০ রানের মাইলস্টোন অতিক্রম করেন। ৩৯টি ম্যাচ খেলে সাকিবের ব্যাটিং গড় তখন ৩৫.৩৭।

বিশ্বের সেরা অল-রাউন্ডার হয়ে ওঠা (২০০৮-২০০৯)
একজন অল-রাউন্ডার হওয়া সত্ত্বেও অক্টোবর,২০০৮ এর নিউজিল্যান্ডের বাংলাদেশ ট্যুরের আগ পর্যন্ত সাকিবকে বোলার নয়, ব্যাটসম্যান হিসেবেই গণ্য করা হত। টেস্টে সাত নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামলেও ওয়ানডেতে কিন্তু প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যেই থাকতেন তিনি। ট্যুরের আগ দিয়ে কোচ জিমি সিডন্স জানালেন, সাকিবকে স্পেশালিস্ট বোলার হিসেবেই টেস্ট সিরিজ খেলানো হবে। কোচকে হতাশ করেননি সাকিব। উদ্বোধনী টেস্টের প্রথম ইনিংসেই তিনি ৩৭ রান দিয়ে তুলে নেন ৭টি উইকেট। তখন পর্যন্ত কোন বাংলাদেশী বোলারের টেস্টে এটাই ছিল বেস্ট বোলিং ফিগার। বাংলাদেশ সিরিজ হারে ২-০ তে, কিন্তু সাকিব ১৭.৮০ গড়ে ১০টি উইকেট নিয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হন। ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচটিতে বাংলাদেশ জয় পায়। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম জয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য স্বাগতিক দল সিরিজ হারে ২-১ এ। সাকিব ৩ ম্যাচে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে মাশরাফি মুর্তজা (৭ উইকেট)’র পেছনে থেকে সিরিজে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হন।

পরের মাসেই বাংলাদেশ দল দুটি টেস্ট, তিনটি ওয়ানডে ও একটি টি-২০ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায়। সাকিবের বোলিং পারফরম্যান্স এখানেও অব্যাহত থাকে। প্রথম টেস্টের প্রথম দিন সাকিব উইকেটশূন্য থাকলে মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন, বাংলাদেশের তৎকালীন সহকারী কোচ, তাকে বলে ‘ফ্লাইট’ দেবার পরামর্শ দেন। গুরুর উপদেশ শিরোধার্য করে সাকিব দ্বিতীয় দিনেই পাঁচ-পাঁচটি উইকেট তুলে নেন। দ্বিতীয় টেস্টে সাকিব আবারও এক ইনিংসে ৫ উইকেট তুলে নেন। সিরিজ শেষে সাকিবের ঝুলিতে জমা হয় ২০.৮১ গড়ে ১১টি উইকেট। সাকিবের বোলিং দেখে মুগ্ধ অস্ট্রেলিয়ার সাবেক লেগ স্পিনার ক্যারি ও’ কীফে তাকে ‘বিশ্বের সেরা ফিঙ্গার স্পিনার’ হিসেবে অভিহিত করেন। ২০০৮ এর ডিসেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কা এদেশে দুটি টেস্ট ও একটি ত্রি-দেশীয় ওয়ানডে টুর্নামেন্ট (অপর দলটি ছিল জিম্বাবুয়ে) খেলতে আসে। দুটো টেস্টই শ্রীলঙ্কা জিতে নেয়। সেই সাথে ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালও। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে অবশ্য সাকিবের করা ৯২* রানের ইনিংসটি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজের একমাত্র জয়ের স্বাদ এনে দেয়। সাকিব ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন।

২২ জানুয়ারী, ২০০৯ সাকিব আইসিসি’র ওডিআই অল-রাউন্ডার র‌্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বরে উঠে আসেন। ২০১১ সালে আইপিএল এর নিলামে তাকে ৪ লাখ ২৫ হাজার ডলারের বিনিময়ে কলকাতা নাইট রাইডার্স কিনে নেয়।

সহ-অধিনায়কত্ব ও অধিনায়কত্ব (২০০৯-২০১০)
ক্রিকেট ইতিহাসেই টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তিন ধরনের ক্রিকেটে একই সময়ে এক নম্বরে থাকা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি। ২০১৫ সালে সাকিব এই কৃতিত্ব প্রথম করে দেখান। সাকিব নিজে নিজের এই কৃতিত্ব আবার করে দেখিয়েছেন, যা আর কোনো দেশের ক্রিকেটার পারেননি। আরেকটি অলরাউন্ড কৃতিত্বে সাকিব অনন্য হয়ে আছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ওয়ানডেতে ৫ হাজার রান ও ২০০ মাইলফলক স্পর্শ করেন। মাত্র ১৭৮টি ওয়ানডে লেগেছে তাঁর। এত দ্রুত এই কৃতিত্ব আর কেউ করতে পারেনি। সাকিব টেস্ট ইতিহাসে তিন অলরাউন্ডারের একজন, একই ম্যাচে সেঞ্চুরি আর ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব আছে যাঁদের।

বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট সাকিবের। ওয়ানডেতেও সবচেয়ে বেশি উইকেটের লড়াইটা চলছে মাশরাফি বিন মুর্তজার সঙ্গে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওয়ানডেতে সাকিবের উইকেট ২৩৫টি, মাশরাফির ২৩৭টি। টেস্টে সাকিবের উইকেট ১৮৮টি। টেস্টে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের পক্ষে সর্বোচ্চ ইনিংসটিও তাঁর। টেস্টে ৯ প্রতিপক্ষের সবার বিপক্ষে ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া ইতিহাসের মাত্র চতুর্থ বোলার সাকিব।

সাকিব আল হাসানের অভিষেক ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট, জিম্বাবুয়ের সফরের ওয়ানডেতে। ২০০৭ সালে মে মাসে চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয়। দ্রুতই তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রাণ হয়ে ওঠেন। অবশ্য বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় তারকার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল তাঁর উঠতি বয়স থেকে। খেলা পাগল সাকিবকে বিকেএসপিতে (বাংলাদেশে ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) ভর্তি করিয়ে দেন তাঁর বাবা মাশরুর রেজা। মাশরুর নিজে মাগুরার ফুটবলার ছিলেন। সাকিবের ফুপাতো ভাই মেহেদী হাসান উজ্জ্বল বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলেও খেলেছেন।

ক্রীড়া-পাগল এক পরিবার থেকে উঠে এলেও সাকিবের খেলোয়াড় হতে চাওয়া সহজ ছিল না। নতুন সহস্রাব্দের শুরুতেও খেলাধুলাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে পারার কথা মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে ভাবতে পারতেন না। সেখান থেকে একে একে সাফল্যের সিঁড়ি ভেঙে সাকিব বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি তারকার একজন হয়ে উঠেছেন। আইপিএলের মতো টি-টোয়েন্টি লিগের সেরা তারকাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০১১ সালে ৪ লাখ ২৫ হাজার ডলারে সাকিবকে কিনে নিয়েছিল কলকাতা নাইট রাইডার্স।

২০১৮ আইপিএলের নিলামে সাকিবকে ২ কোটি রুপিতে কিনে নেয় সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। আইপিএল ছাড়াও সাকিব অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ, পাকিস্তানের পিএসএল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিপিএল, শ্রীলঙ্কার এসএলপিএল লিগগুলোতে খেলেছেন। এর মধ্যে সিপিএলে তাঁর ৬ রানে ৬ উইকেট টি-টোয়েন্টির সেরা বোলিংগুলোর একটি হয়ে আছে। সাকিব ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটেও খেলেছেন। এভাবেই বাংলাদেশের এ সময়ের সেরা আইকনদের একজন সাকিব বিশ্ব ক্রিকেটেও বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।

২০০৯ সালে সাকিব প্রথম ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেন। সাকিবের নেতৃত্বে সেবার বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ জিতে আসে। ২০১১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও সাকিব নেতৃত্ব দেন। পরে নানা বিতর্কের মুখে সাকিব নেতৃত্ব হারান। সাকিব তাঁর ক্যারিয়ারে বিতর্কেও জড়িয়েছেন নানা সময়ে। বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধও হয়েছেন।

সপরিবারে সাকিব – প্রথম আলো২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর সাকিব উম্মে আহমেদ শিশিরকে বিয়ে করেন। ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের উস্টারশায়ারের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে সাকিবের সঙ্গে শিশিরের পরিচয় হয়। ২০১৫ সালে সাকিব ও শিশিরের মেয়ে আলায়না হাসান অব্রি জন্ম নেয়। শিক্ষাগত জীবনে সাকিব এআইইউবি (আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ) থেকে বিবিএ পাস করেছেন। সাকিব ফুটবলেরও ভীষণ পাগল। বার্সেলোনা ও লিওনেল মেসির সমর্থক। সাকিব ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্বীকৃতি প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে চারবার বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত হয়েছেন।

Related posts

রান না পাওয়ায় হতাশ, ছুটির দিনেও অনুশীলনে সাকিব

News Desk

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে চেলসি

News Desk

কেন হারলো বাংলাদেশ! জানেন গাভাস্কার

News Desk

Leave a Comment