Image default
লাইফ স্টাইল

শিশুর মানসিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা

‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে…আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই…।’ মা-বাবার ঘরটা হয়তো শিশুর জন্য সাজানো বাগানই। কিন্তু এই পৃথিবীটাকে কি আমরা করতে পেরেছি তার জন্য সাজানো বাগানের মতো? অথবা সুকান্তের সেই বাসযোগ্য পৃথিবী? হয়তো পেরে উঠি না আমরা; কিন্তু শিশুটিকে আমরা যদি বড় করে তুলি আপন মমতায়, সঠিক বিকাশে, তাহলে সে হয়তো তার পৃথিবীটাকে তার মতো করেই বাসযোগ্য করে তুলবে। মনের মতো সাজাবে আপন পৃথিবীর বাগানটাকে।

কার্টুনের ভক্ত মাইশা স্কুল থেকে ফিরেই টিভির রিমোট নিয়ে বসে পড়ে। টম অ্যান্ড জেরি, মিকি মাউস, ডিজনিসহ তার পছন্দের তালিকা অনেক দীর্ঘ। কৌতূহলবশত একদিন ভয়ের সিনেমা দেখে তো অবস্থা খারাপ। ভয়ে সারা রাত ঘুমাতে পারল না। বাথরুমে যেতে হলেও মাকে দরকার। সারাক্ষণ যেন সিনেমার অ্যানাকোন্ডা মাথার মধ্যে ঘুরছে।

কোমলমতি শিশুরা অনেক সময় গল্প শুনে বা ছবি দেখে ভয় পায়, আর এই ভয় শিশুর মনের গভীরে ছাপ ফেলে। ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ হয় বাধাগ্রস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের কোনো কাজ করানোর জন্য ভয় দেখালে তা তার মনে গেঁথে যায়। এর ফলে ওই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এতে শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশ ব্যাহত হয়। তাই শিশুদের কোনোভাবেই ভয় দেখানো উচিত নয়।

আবার পারিবারিক কলহের চাপে অনেক শিশুর স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড় হয়, তারা হতাশ, অসামাজিক ও সহিংস হয়ে ওঠে। নানা অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে মনঃসংযোগের ঘাটতিও দেখা দেয়। মানসিক রোগ ও ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা ঘটতে পারে। ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১২’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ১৮.৩৫ শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এমন ঘটনা আবার মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুর মধ্যে বেশি। মেয়েশিশুর ১৭.৪৭ শতাংশের পাশাপাশি ১৯.২১ শতাংশ ছেলেশিশু মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে। গবেষকরা বলেন, ‘শিশুদের ওপর মানসিক আঘাতের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর। যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মানসিক আঘাত শিশুর পরবর্তী জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে, আবেগজাত সমস্যায় আক্রান্ত করে।’

প্রতিদিন মা-বাবার ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক শিশুর মধ্যে পরবর্তীকালে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতাও দেখা যায়। সমাজে মানিয়ে চলতে অসুবিধা হয় তাদের। গর্ভকালে যেসব মা নির্যাতনের শিকার হন অথবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, তাঁদের সন্তানও জন্মের পর নানা জটিলতায় ভোগে। নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাই মেডিক্যাল সেন্টারের ট্রমাটিক স্ট্রেস স্টাডিজ বিভাগে সম্পন্ন এক গবেষণায় দেখা যায়, মাতৃগর্ভে থাকার সময় যাদের মা মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছিলেন, সেই শিশুরা সহজেই মানসিক চাপে ভেঙে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অ্যাংজাইটি বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডার হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা অথবা মাকে নির্যাতিত হতে দেখা শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে তারা হয় বিশেষভাবে অরক্ষিত ও অসহায়। এসব শিশু পরবর্তীকালে হিংস্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। বিষণ্নতা বা তীব্র দুশ্চিন্তায় ভোগার ঝুঁকিতেও পড়তে পারে এসব শিশু।’ শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার ভালোবাসা ও সান্নিধ্যের কোনো বিকল্প নেই। পরিবারে মাকে নির্যাতিত হতে দেখলে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শিশুর মা-বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সম্পর্ক শিশুর মধ্যে পরম সুখ ও নিরাপত্তাবোধ জাগায়। বাবাকেও তাই শিশুর মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে। ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমান বলেন, ‘পারিবারিক নির্যাতন দেখে বেড়ে ওঠা শিশুরা এমন ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে যে অন্যকে আঘাত করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। সে যে কাউকে আঘাত করতে পারে। আবার সেও অন্যের কাছ থেকে আঘাত পেতে পারে। তাই বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।’

বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধি হলো শারীরিক বিকাশ। আর মানসিক বিকাশ হলো আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা, কথা বলা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষমতা অর্জন। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশু তথা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। গর্ভকালে মায়ের অপুষ্টি, মা-বাবার মধ্যে কলহ, পারিবারিক নির্যাতন, মাদকাসক্তি, থাইরয়েড ও অন্যান্য হরমোনের আধিক্য ও অভাব, জন্মগত ত্রুটি, প্রসবকালীন জটিলতা, শব্দদূষণ, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ইত্যাদি কারণে শিশুর বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় মা-বাবার ভূমিকা

শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য মা-বাবাকেই নিতে হবে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। মা-বাবা ছাড়া শিশুর চারপাশের পরিচিত মানুষরাই তার বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রধান কারণ মা-বাবা সন্তানের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটান, তাদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন, সর্বদা তাদের মঙ্গল কামনা করেন এবং অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে তাদের বুঝতে পারেন। তাই সন্তানরাও মা-বাবার ওপর ভরসা ও নির্ভর করে। শিশুরা অনেক সময় তাদের বন্ধুবান্ধব ও ভাই-বোনের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখে। তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য শিশুর কাছ থেকে শেখার চেয়ে বড়দের সহযোগিতার মাধ্যমে কোনো কিছু শিখলে শিশুদের বিকাশ বেশি হয়। বর্তমান যুগে পরিস্থিতি অনেক সময় এমন হয়ে যায় যে মা-বাবা দুজনকেই জীবিকার জন্য কাজে বের হতে হয়। ফলে শিশুকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় তাঁদের থাকে না। অনেকেই নির্ভর করেন কাজের মানুষের ওপর। এ জন্য যতটুকু সময়ই তাঁরা শিশুর কাছে থাকতে পারেন, সে সময়টাকে মানসম্মত করে তুলতে পারলে সেটা শিশুর বিকাশে অনেক অবদান রাখতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, শিশুর মৌলিক চাহিদাগুলো অপূর্ণ থাকার জন্য কিন্তু তার মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষুণ্ন হয়। তাই তার স্বাধীনতার চাহিদা, আত্মস্বীকৃতির চাহিদা, সক্রিয়তার চাহিদা, নিরাপত্তায় চাহিদা প্রভৃতি যাতে তার বাসগৃহ ও বিদ্যালয়ে পূরণ করার সুযোগ পায়, সেদিকে লক্ষ রাখা আবশ্যক। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাসগৃহ ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অনুকূল হওয়া প্রয়োজন।

তথ্য সূত্র: টিচার্স গভঃ বিডি,, উইকিপিডিয়া

Related posts

ব্যাগ নিয়ে মুম্বাইয়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তানিয়া

News Desk

তীব্র শীতে অসুস্থতা বেড়েছে শিশুদের

News Desk

চুলায় তৈরি শিক কাবাব

News Desk

Leave a Comment