মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস

পৃথিবীর খুব কমসংখ্যক জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাঙালি তেমনি একটি জাতি, যার দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের ইতিহাস রয়েছে। স্বাধীনতার পরে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষিত হলেও প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা হিসেবে পুলিশ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সেভাবে সংরক্ষিত ছিল না। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। বর্তমানে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা পুলিশের সেই সময়ের স্মৃতি বহন করছে ‘পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রতিষ্ঠিত এই পুলিশ জাদুঘর এখন ইতিহাস ও গৌরবের সাক্ষী।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনেই প্রথম পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মর্টার, কামান, ট্যাঙ্ক আর ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। সেদিন জীবন বাজী রেখে লড়াই করেছিলেন পুলিশ সদস্যরা। শহীদ হয়েছিলেন দেশের জন্য।

মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম আক্রমণের শিকার হয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন।

সেখান থেকেই শুরু হয় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেই রাজারবাগ পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের পাশেই দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

পাগলা ঘণ্টা

পাগলা ঘণ্টা
ছবি: prothomalo.com

পাকা লোহার একটা দণ্ড- এটাই পাগলা ঘণ্টা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পুলিশ লাইনস আক্রমণের মুহূর্তে এই পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে পুলিশ সদস্যদের একত্র করে প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয়। সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, পাগলা ঘণ্টার আওয়াজ শুনে রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা সালামি গার্ডের পাশে জড়ো হন এবং অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে প্রতিরোধ গড়তে অবস্থান নেন। পাগলা ঘণ্টা বাজানোর কাজটি করেছিলেন পুলিশ সদস্য আবদুল আলী।

বেতারযন্ত্র

বেতারযন্ত্র

রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের খবর পাঠানো হয় কন্ট্রোল রুমে রাখা এই বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ‘হেলিকপ্টার ব্যাজ’ মডেলের একটি বেতারযন্ত্র থেকে এই বার্তাটি পাঠান সেই সময়ের বেতার অপারেটর মো. শাহজাহান মিয়া।

স্মৃতির বেঞ্চ

স্মৃতির বেঞ্চ
ছবি: prothomalo.com

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আহত দুই পুলিশ সদস্যকে নেওয়া হয় মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির হাসপাতালে। সেই মুহূর্তে হাসপাতালে কোনো শয্যা ছিল না। তাদের দুজনকে এ দুটি বেঞ্চের ওপর রেখেই চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়ে অজ্ঞাত ওই দুই পুলিশ সদস্য সেখানেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।

থ্রি নট থ্রি রাইফেল

থ্রি নট থ্রি রাইফেল

সেই কালরাতে পুলিশ সদস্যদের হাতে ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। পাকিস্তানি বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে এ অস্ত্র দিয়েই লড়েছিলেন বাঙালি পুলিশ সদস্যরা।

বীরদের স্মারক

মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টার শেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ, অণুবীক্ষণযন্ত্র, সার্চলাইট, ট্রাংক ও ইউনিফর্ম রাখা হয়েছে। দেয়ালজুড়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার। এর মধ্যেই পাওয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত নানা জিনিস। সেসব স্মারকের তালিকায় রয়েছে তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার শহিদ ফয়জুর রহমান আহমেদের ব্যবহৃত রেডিও ও ডায়েরি। শহিদ ফয়জুর রহমান আহমেদ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা।

Related posts

শাফী ইমাম রুমী: আর ফিরে আসেনি

News Desk

ছয় দফাকে বাংলার মুক্তির সনদ বলা হয় কেন?

News Desk

মেজর জলিল : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ‘খেতাবহীন’ সেক্টর কমান্ডার

News Desk

Leave a Comment