Image default
আন্তর্জাতিক

সেই ইউএনও আরও বেপরোয়া, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ভিকটিম

অস্ত্রের মুখে সম্ভ্রম লুট। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে বিলম্বিত বিচার। জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভিকটিম একদিনের জন্যও আদালত চত্বরে যেতে পারেননি। এভাবে কেটে গেছে একে একে ১৪টি বছর। পারিবারিক মানমর্যাদা ও ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করে একপর্যায়ে ভিকটিম মামলা চালানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। কিন্তু বিয়ে-সংসার বা সন্তানের স্বপ্ন থাকলেও সবই ঢাকা পড়ে অন্ধকার এই মেঘের আড়ালে। জীবনের এ ক্ষত তাকে এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এ ঘটনায় বিয়ে নামক শব্দটা তার জীবন থেকে এক রকম পালিয়ে গেছে।

Mir Concrete
ওদিকে হিংস্র হায়েনাদের আক্রমণের সময় তিনি ছিলেন ২১ বছরের উচ্ছ্বল তরুণী। বহমান সময়ের স্রোতে ভেসে এখন তিনি চল্লিশের কাছাকাছি। কিন্তু থেমে নেই জীবন সংগ্রাম। একটু সুখের আশায় ঘর বাঁধতে চেয়েছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে। সব জেনেশুনে প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে গোপনে সংসার শুরু করেন প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তা। ৩০তম ব্যাচের এই গুণধর কর্মকর্তার নাম আসিফ ইমতিয়াজ। তিনি তখন সুনামগঞ্জের তাহেরপুরের ইউএনও। স্ত্রীর সঙ্গে বনাবনি না হওয়ার কথা বলে ইউএনও সাহেব এ অসহায় মেয়েকে নিয়ে নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখান। সময়টা ছিল ২০১৭। ভাঙা জীবনে ঠাঁই পেতে সরল বিশ্বাসে সব সপে দেন ভিকটিম। কিন্তু খুব বেশিদিন পার হয়নি। স্বপ্ন দেখানো কর্মকর্তা ঘোর কেটে গেলে কিছুদিনের মধ্যে স্বপ্নের সব ফানুস আকাশে উড়িয়ে দেন। এরপর পড়ে থাকে শুধুই কল্পনা। সামনে আসতে থাকে আসল স্বরূপ। কিছুদিনের মধ্যে মুখের আড়ালে থাকা মুখোশ বেরিয়ে আসে। এভাবে নতুন করে মোড় নেয় তরুণীর দুঃখগাথা জীবনের আরেক পর্ব। যার চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে যুগান্তরের অনুসন্ধানে।

নারীঘটিত অসদাচরণের ঘটনায় আসিফ ইমতিয়াজ ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হন। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। সম্প্রতি বিভাগীয় মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এর জের ধরে তিনি ভুক্তভোগী ভিকটিমকে মিথ্যা মামলায় সিআইডি পুলিশ দিয়ে হেনস্তার অপচেষ্টা করেন। তবে পুলিশ প্রকৃত সত্য জানার পর ভিকটিমকে ছেড়ে দেয়। সর্বশেষ কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে ওএসডি থাকা সিনিয়র সহকারী সচিব আসিফ ইমতিয়াজ ভিকটিমের সেই ধর্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। নানা রকম প্রলোভন দিয়ে তাদের দিয়ে দুদফা মিথ্যা মামলা করানোর চেষ্টাও করেন আসিফ ইমতিয়াজ। কিন্তু আদালত পুরো নথি তলব করে সত্য বুঝতে পারেন এবং মামলা খারিজ করে দেন।

ভয়ংকর সেই স্মৃতি : ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। ভুক্তভোগীর জীবনে বয়ে যায় কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলা। দেলোয়ার নামের এক নরপশুর হিংস্র থাবায় তার স্বাভাবিক জীবন ছিন্নভিন্ন। উপর্যুপরি ধর্ষণে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে লোকলজ্জার ভয়ে রাজধানী ছাড়েন ভুক্তভোগী। কিন্তু এতেও শেষরক্ষা হয়নি। মাস্তান বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে। হত্যার উদ্দেশ্যে একাধিকবার হামলাও চালানো হয়।

ভুক্তভোগী যুগান্তরকে বলেন, মেরুল বাড্ডা এলাকায় দেলোয়ার এন্টারপ্রাইজ নামের এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। নিচতলায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দোতলায় মালিক দেলোয়ার হোসেনের বাসা। হঠাৎ একদিন অফিস ছুটির পর লেনদেন বুঝিয়ে দিতে তাকে দোতলায় যেতে বলা হয়। তখন সন্ধ্যা। ভেতরে ঢোকার পর তিনি বুঝতে পারেন বাসা ফাঁকা। দেলোয়ার ছাড়া ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই। এ সময় অসংলগ্ন কথাবার্তার ফাঁকে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন দেলোয়ার। এতে বিপদের গন্ধ পান ভুক্তভোগী। পরিস্থিতি আঁচ করে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউ একজন বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এ সময় তার দিকে পিস্তল তাক করেন দেলোয়ার। ফ্ল্যাটে আটকে তাকে রাতভর ধর্ষণ করা হয়।

তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কয়েকদিন পর এক সহকর্মীর পরামর্শে সোবহান মিয়া নামের স্থানীয় প্রভাবশালীর কাছে অভিযোগ জানিয়ে আরেক দফা বিপদে পড়েন তিনি। বিচারের নামে তাকে ফের নিয়ে যাওয়া হয় দেলোয়ারের ফ্ল্যাটে। সেখানে দ্বিতীয় দফায় তাকে ধর্ষণ করেন সোবহান মিয়া। এ সময় ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে রাখা হয়। এরপর ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে দোলোয়ার-সোবহানগং দিনের পর দিন তাকে ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে মামলা করতে থানায় যান ভুক্তভোগী। কিন্তু আসামিদের নাম শুনে তাকে ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। পরে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন।

মামলা : ২০০৮ সালের ৭ জানুয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালত-৭ এ ধর্ষণ মামলা করা হয়। এজাহারে দেলোয়ার হোসেন ও সোবহান মিয়া ছাড়াও সৈয়দা ফহিমা খানম ওরফে লাভলী এবং সোহরাব হোসেন নামের দুই সহযোগীকে আসামি করা হয়। অভিযোগ আমলে নিয়ে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। তদন্তে নামেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মীনাক্ষী বর্মণ। তিনি সরেজমিন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর মৌখিক সাক্ষ্য ছাড়াও তিনজনের লিখিত জবানবন্দি নেন।

জবানবন্দি : নজরুল ইসলাম নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী লিখিত জবানবন্দিতে বলেন, ‘বেলা আনুমানিক ২/২.৩০ মিনিটের দিকে আমি বাজারের মুখে হঠাৎ শব্দ শুনে বের হই। এ সময় দেখি অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সেখানে একটি মেয়েকে কান্না করে কথা বলতে শুনি। মেয়েটার গায়ে ছেঁড়া কাপড় এবং মুখে দাগ ছিল। দেলোয়ার এবং সোবহান বাদীকে রেপ করেছে। বাদী বাজারের অফিসে বিচার দিচ্ছিল। আসামিরা খুবই ভয়ংকর। ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে চায় না।’

দ্বিতীয় প্রত্যক্ষদর্শী রেফাতুল আলম বলেন, ‘মেরুল বাড্ডা বাজারে সোবহান এবং দেলোয়ারের অফিস আছে। এটা ছাড়াও তাদের আরও একটি অফিস আছে ল-৩২/৮ ঠিকানায়। আনুমানিক ২/৩টার সময় আমি আমার পার্টনারসহ অফিসে বসা ছিলাম। এ মামলার বাদী কাঁদতে কাঁদতে এসে বলে দেলোয়ার গত ১৫-১১-২০০৭ তারিখে বাদীকে রেপ করেছে এবং ১৭-১১-২০০৭ তারিখে সোবহান রেপ করেছে। তখন আশপাশের অনেক লোক বাদীর এই কথা শুনেছে। এর আগেও দেলোয়ার এরকম ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে আসামিদের সম্পর্ক ভালো। তাই থানায় মামলা নেয় না।’

তৃতীয় প্রত্যক্ষদর্শী শফিকুল ইসলাম তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি বাড্ডা কিচেন সুপার মার্কেটের মালিক। বেলা আনুমানিক ২টার দিকে বাদী তার কাছে গিয়ে জানান, দেলোয়ার এবং সোবহান তাকে ধর্ষণ করেছে। আসামি দেলোয়ার এবং তার আত্মীয়স্বজনের এমন ঘটনা আগেও শুনেছি। আমরা বাদীকে মহিলা কমিশনারের কাছে যেতে বলি। সোবহানকে এ ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে যেন এই বিষয়ে কোনো কথা না বলি।’

সরেজমিন তদন্ত শেষে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ২০০৮ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেন। এতে বলা হয়, ‘বাদী ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং নালিশি দরখাস্ত পর্যালোচনান্তে দেখা যায়, বাদীর জবানবন্দি এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্য পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তা নালিশি অভিযোগকে সমর্থন করে। সার্বিক বিবেচনায় নালিশি অভিযোগে উল্লিখিত ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।’

ভুক্তভোগী যুগান্তরকে বলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্তে ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন আসামিরা। ঢাকায় থাকলে জীবনে মেরে ফেলা হবে। এর ফলে চরম নিরাপত্তাহীনতার মুখে তিনি ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হন। যথাসময়ে আদালতে হাজির হতে না পারায় বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। একপর্যায়ে মামলার সব আসামি অব্যাহতি পেলেও দুই নম্বর আসামি সোবহান মিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। সোবহান মিয়া ভুক্তভোগীর কাছে সমঝোতার প্রস্তাব পাঠান। দুপক্ষের উপস্থিতিতে সালিশ বৈঠকে ঘটনার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চান সোবহান মিয়াসহ অন্য আসামিরা। এ সময় ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সমঝোতায় রাজি হন। ভুক্তভোগীকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে বলেন তারা।

এর কিছুদিন পর তাহিরপুরের তৎকালীন ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আসিফ ইমতিয়াজ তাকে জানান, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি সুখী নন। তিনি ভুক্তভোগীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অনেকটা গোপনেই তাদের বিয়ে হয়। কিছুদিন পর আসিফ ইমতিয়াজের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। চট্টগ্রাম ডিসি অফিসের এলএ শাখায় কর্মরত থাকাবস্থায় মোটা অঙ্কের ঘুসের টাকা জমা রাখতে তিনি গোপনে ভুক্তভোগীর নামে ব্যাংক হিসাব খোলেন। একপর্যায়ে ঘটনা জানাজানি হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আসিফ ইমতিয়াজকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এতে ক্ষিপ্ত হন তিনি। ধর্ষণ মামলার আসামিদের সঙ্গে হাত মেলান। পরিকল্পনামাফিক ৩ অক্টোবর মানহানির সাজানো মামলা করেন ধর্ষণ মামলার তিন নম্বর আসামি সৈয়দা ফাহিমা খানম লাভলী। অবশ্য ১১ অক্টোবর এ মামলা খারিজ করে দেন আদালত।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সৈয়দা ফাহিমা খানম লাভলী শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘তিনি নির্দোষ হলেও অহেতুক তাকে ধর্ষণ মামলায় জড়ানো হয়। এ কারণে এখন তিনি মানহানির মামলা করেছেন। এক্ষেত্রে কেউ তাকে সহায়তা করেনি। আসিফ ইমতিয়াজ নামের কাউকে তিনি চেনেন না।’

তবে ধর্ষণ মামলার এক নম্বর আসামি দেলোয়ার হোসেনের ভাগ্নি জামাই জামাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আসিফ ইমতিয়াজ নামের এক সরকারি কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করলে টাকা-পয়সারও লোভ দেখাচ্ছেন তিনি। এ নিয়ে আর কোনো ঝামেলায় আমরা জড়াতে চাই না বলার পরও তিনি রীতিমতো নাছোড়বান্দা।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে সাবেক ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজের সঙ্গে শনিবার সন্ধ্যায় একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে খুদেবার্তা পাঠানোর পরও তিনি কল ব্যাক করেননি।

Related posts

ক্যাপিটলে বোমা হামলার হুমকি, ‘ট্রাম্পসমর্থক’ গ্রেফতার

News Desk

মার্কিন বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের মামলা

News Desk

জার্মানির ৪০ জন কূটনীতিক এবং দূতাবাসকর্মীকে বহিষ্কার করে ‘জবাব’ রাশিয়ার

News Desk

Leave a Comment