Image default
আন্তর্জাতিক

গ্যাস নিয়ে ঠাণ্ডা যুদ্ধ ইউরোপ ও রাশিয়ার

ছবি: সংগৃহীত

ফ্রান্সের ঐতিহাসিক বাস্তিল দিবস ছিল গত ১৪ জুলাই। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাখো এদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে জানিয়ে দেন, আপনারা প্রস্তুত হোন। রুশ গ্যাসের জোগান থেমে যেতে পারে যে কোনো দিন। দেশটি প্রতি মাসে তাদের চাহিদার ১৬ শতাংশ গ্যাস আমদানি করে রাশিয়া থেকে। কেবল ফ্রান্স নয়, আসন্ন শীতে ঘরবাড়ি গরম রাখা কিংবা নৈমিত্তিক রান্নাবান্নার জন্য পুরো ইউরোপই প্রধানত রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। এ গ্যাস ছাড়া মহাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখাই দুষ্কর।

গ্যাস-সংকটে দিশাহারা ইউরোপ। রুশ গ্যাস জোগান সংক্রান্ত এসব প্রশ্ন জারি থাকার মধ্যেই ইউরোপে গ্যাসের জোগান আরো ২০ শতাংশ কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। পুতিনের ঘোষণার দুদিনের মধ্যে ইউরোপে ৩০ শতাংশ বেড়েছে গ্যাসের দাম। গত বছরের তুলনায় ১০ গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে এসব দেশের শিল্পোৎপাদন আর বাজারের ওপর। নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে হু হু গতিতে। আকাশ ছুঁয়েছে মূল্যস্ফীতি। মস্কোর এ সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে রয়েছে দক্ষিণ ইউরোপ, তথা ইতালি ও জার্মানি। ইউরোপে সবচেয়ে বেশি রুশ গ্যাস আমদানি করে এ দুই দেশ। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া তার গ্যাসের জোগান যত সংকুচিত করবে, ইউরোপ ততটাই বেশি উদ্যোগী হবে এর বিকল্প খোঁজার জন্য। চূড়ান্ত পরিণতিতে মূল ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাশিয়াই।

২০২১ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রতি মাসে ১২ বিলিয়ন ইউরোর জ¦ালানি কেনে ইউরোপ। ২০২২ সালের শুরুতে ইউক্রেন যুদ্ধ মাঠে গড়ানোর পর একদিকে যেমন তেল-গ্যাসের দাম বাড়ে বিশ্বে, অন্যদিকে ইউরোপে জ¦ালানি বিক্রিও বৃদ্ধি পায় রাশিয়ার। হিসাব বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রতি মাসে ২২ বিলিয়ন ডলারের রুশ গ্যাস কিনে আসছে ইউরোপ। মহাদেশের মোট চাহিদার প্রায় অর্ধেক গ্যাস যায় রাশিয়া থেকে। প্রধানত নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইনের মাধ্যমে এই গ্যাস ছড়িয়ে যায় দেশে দেশে। এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপীয় কমিশন। তারা আগে থেকেই বলে আসছিল, জ¦ালানি-বিপর্যয়ে পড়তে না চাইলে মহাদেশজুড়ে গ্যাসের ব্যবহার কমপক্ষে ১৫ শতাংশ কমাতে হবে। কিন্তু তাদের এ পরামর্শ শুরুতেই বিরোধিতা করে বেশ কয়েকটি দেশ। হাঙ্গেরি সরাসরি জানিয়ে দেয়, গ্যাসের ব্যবহার কমানো তাদের পক্ষে অসম্ভব। যদিও জ¦ালানি বিষয়ে দেশের মধ্যে জরুরি অবস্থা এরই মধ্যেই ঘোষণা করেছে দেশটি। ধারণা করা হচ্ছে, যুদ্ধের টানাপড়েনে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করলে পরবর্তী ধাপে এই কৃচ্ছ্রতাসাধনের বিষয়টি বাধ্যতামূলকও করা হতে পারে।

এদিকে ক্রেমলিন বলছে, সরবরাহকারী হিসেবে রাশিয়া একটি নির্ভরযোগ্য দেশ। কিন্তু সম্প্রতি রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তার ফলে বিঘ্ন ঘটছে গ্যাস সরবরাহে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মালিকানাধীন পাঁচ লাখ কর্মীসমৃদ্ধ কোম্পানি গ্যাজপ্রম বলছে, কানাডায় তাদের যন্ত্রাংশের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে সেগুলো ফেরত আসতে দেরি হয়েছে। এ কারণেই তারা এর আগে নর্ড স্ট্রিম ওয়ানের সরবরাহ ৪০ শতাংশে সীমিত রাখতে বাধ্য হয়। গ্যাজপ্রম প্রধান আলেক্সি মিলার এ বিষয়ে বলেন, আমাদের পণ্য, আমাদের নিয়ম। যে নিয়ম আমরা তৈরি করিনি, সে নিয়ম মেনে আমরা কাজ করি না। ইউরো অথবা ডলারের বদলে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধে অস্বীকৃতি জানানোর পর এর আগেই ইউরোপের বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে রাশিয়া।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট তার বাস্তিল দিবসের ভাষণে রুশ গ্যাসের ব্যাপারে দেশবাসীকে সতর্ক করার পাশাাপশি মস্কোর বিরুদ্ধে জ্বালানিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ তোলেন। এ অভিযোগ মূলত ইইউর সুরেরই প্রতিধ্বনি। গত এপ্রিলের শেষদিকে ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন জ্বালানি নিয়ে রাশিয়া বিশ্বকে ব্ল্যাকমেল করছে বলে অভিযোগ ছুড়ে দেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রান্স কিংবা ইইউ জ্বালানি সংকটের দরুন জীবনযাত্রার ভোগান্তি বাড়ার বিষয়টি নিয়ে সরব হলেও রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন। অথচ যুদ্ধের শুরু থেকেই গ্যাস সংকটের মূলে রয়েছে এ নতজানু নীতি। ভ্লাদিমির পুতিন একবারও গ্যাস বন্ধ করার কথা বলেননি। বরং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিই বারবার রুশ জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পশ্চিমা বিশ্বকে উসকে দিয়েছেন। নতুন করে গ্যাসের জোগান বন্ধের ঘোষণার পর জেলেনস্কি আবার মস্কোকে মূল্য-সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত করেন। এই জেলেনস্কির উসকানিতেই পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ তৎপর হতে শুরু করে। আর এটি করতে গিয়ে তারা বিপদ ডেকে আনে নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর।

চলতি মাসের শুরুতে জেলেনস্কিই কানাডাকে পরামর্শ দেন, নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের রুশ যন্ত্রাংশ ফেরত না দেয়ার জন্য। বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন দোনোমনা থাকার পর কানাডা এসব সরঞ্জাম ফেরতে রাজি হলেও জেলেনস্কি তাদের বলেন বিষয়টি নিয়ে আবার ভাবতে। পরে সরঞ্জাম ফেরত দেয়া হলেও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গ্যাসকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ তোলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ইইউ তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বে জ্বালানির সংকট মিটে যাবে। কিন্তু পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া মানে নিজেদের ভুল স্বীকার করা। এ কারণে তারা পুতিনের নতুন নতুন দোষ খুঁজছে। পশ্চিমা নেতারা এভাবে কেবল তাদের দেশের নাগরিকদেরই বোকা বানাচ্ছে না, তারা রাশিয়াকে একঘরে করতে নিজ দেশের অর্থনীতিরও গুরুতর ক্ষতি সাধন করছে।

ডি- এইচএ

Source link

Related posts

সংকুচিত থাকবে গ্যাসের বৈশ্বিক বাজার

News Desk

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের রেকর্ড দরপতন

News Desk

কাতারের পর্যটন বিষয়ক দূত হলেন ডেভিড বেকহ্যাম

News Desk

Leave a Comment