ভারতের বারানসিতে জ্ঞানবাপী মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতর কোনো মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ শহরের একটি দেওয়ানি আদালত। এই রায়ের পর তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে।
একজন হিন্দু আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বলেছে, কোনো মন্দির ভেঙে ওই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল কি না ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তা সমীক্ষা করে দেখবে। সমীক্ষার খরচ উত্তরপ্রদেশ সরকারকে বহন করতে হবে।
কিন্তু ভারতের মুসলিম নেতারা অনেকেই মনে করছেন, কোর্টের এই রায় অসাংবিধানিক। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ভূমিকাও আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। এই রায় অযোধ্যার পর ভারতে আর একটি মন্দির-মসজিদ বিবাদ নতুন করে উসকে দেবে বলেও অনেক পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করছেন।
ভারতের সুপ্রাচীন শহর বারানসি বা কাশী, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সংসদীয় আসন। সেখানে হিন্দুদের কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও মুসলিমদের জ্ঞানবাপী মসজিদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকশ বছর ধরে।
হিন্দুদের অনেকে বিশ্বাস করেন, মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের হুকুমেই দুই হাজার বছরের প্রাচীন কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের একটা অংশ ভেঙে ফেলে মসজিদ নিমির্ত হয়েছিল। সেই জমি হিন্দুদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতেই বছর দেড়েক আগে আদালতে পিটিশন দাখিল করেন আইনজীবী বিজয়শঙ্কর রাস্তোগি।
বিজয়শঙ্কর রাস্তোগি বলছেন, পুরো জ্ঞানবাপী পরিসর জুড়েই আগে স্বয়ম্ভূ বিশ্বেশ্বর শিবের জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির ছিল। ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে ১৬৬৯ সালে বাদশাহ আওরঙ্গজেব সেই মন্দির ভেঙে ফেলার ফরমান জারি করেন। তবে সেই ফরমানে কোথাও মসজিদ গড়ার কথা বলা ছিল না।
সিভিল কোর্ট তার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এখন রায় দিয়েছেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি মসজিদ চত্বরের ভেতর সমীক্ষা চালিয়ে দেখবে সেখানে আগে কোনো মন্দির ছিল কি না। আর সেই কমিটির দুজন সদস্য হতে হবে মুসলিম।
কিন্তু জ্ঞানবাপী মসজিদ কর্তৃপক্ষ আদালতের কাছ থেকে এ ধরনের রায় আশা করেননি। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য মোহাম্মদ তৌহিদ খানের কথায়, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সার্ভে কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়ার নির্দেশ ঠিক হয়নি বলেই আমরা মনে করি। তবু আদালতের রায়কে আমরা সম্মান করব। সামনে যে ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেটাও নেব।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য জাফরইয়াব জিলানিও প্রশ্ন তুলেছেন, জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে একটি মামলা যখন এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিচারাধীন আছে এবং হাইকোর্ট সেখানে তাদের রায় মুলতুবি রেখেছেন – সেখানে কীভাবে সিভিল জজ এই আদেশ দিতে পারেন?
তাছাড়া ভারতে ১৯৯১ সালে পাস হওয়া ধর্মীয় উপাসনালয় আইনও বলে, অযোধ্যা ছাড়া দেশের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে। বারানসি সিভিল কোর্টের নির্দেশ সেই রায়েরও লঙ্ঘন বলে অনেকে মনে করছেন।
ভারতের ইতিহাসবিদ মৃদুলা মুখার্জি বলেন, ওই আইনটাতে পরিষ্কার লেখা আছে দেশের সব ধর্মস্থানে যেভাবে উপাসনা চলছে সেটাকে কেউ বদলাতে পারবে না। শুধু অযোধ্যায় রামমন্দির-বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণকে সেই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেন, কিন্তু আমরা জানি, রাজনীতির অঙ্ক অন্য হিসেবে চলে। ফলে বিজেপি-আরএসএস বা তাদের সমর্থক উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলি এটাকে রাজনীতিতে কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা তো বলা যায় না।
হায়দ্রাবাদের প্রভাবশালী এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এই রায়ের বৈধতা নিয়ে সন্দিহান। তিনি টুইট বার্তায় বলেন, ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আগেও বহু হিন্দুত্ববাদী মিথ্যার ধাত্রী হিসেবে কাজ করেছে। তাদের কাছ থেকে কোনো নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না।
ভারতের সুপরিচিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব আতিকুর রেহমানও বলছেন, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকেই কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ট্রাস্ট ও জ্ঞানবাপী মসজিদ কর্তৃপক্ষের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছিল এই রায় তার লঙ্ঘন। তাছাড়া নানি পাল্কিওয়ালার মতো কিংবদন্তী আইন-বিশেষজ্ঞ অযোধ্যা মামলার শুনানিতেই বলেছিলেন আদালত আইনের প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাবে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বা ইতিহাসের ভেতর ঢোকার এখতিয়ার তাদের নেই। আর অযোধ্যায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নাটক তো আমরা এর মধ্যেই দেখে ফেলেছি।
ভারতে রামমন্দির আন্দোলনের সময় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর খুব জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘ইয়ে তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়!’ যাতে প্রচ্ছন্ন হুঙ্কার ছিল, অযোধ্যায় মসজিদ ভেঙে রামমন্দির গড়ার পর তারা কাশী-মথুরাতেও মসজিদ দখলের অভিযানে নামবে। জ্ঞানবাপী মসজিদের ভেতরে সার্ভের নির্দেশে সেই হুমকি বাস্তবায়নেরই চেষ্টা দেখতে পাচ্ছেন অনেক পর্যবেক্ষক।
ভারতীয় সাংবাদিক শেখর গুপ্তা এদিন তার নিয়মিত কলামে এমনও মন্তব্য করেছেন, ভারতে অযোধ্যা বিতর্কের আর পুনরাবৃত্তি হবে না, সেই আশাতেও জল ঢেলে দিয়ে দেশের ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রাকে অনিশ্চিত করে তুলতে পারে জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে কোর্টের এই বিতর্কিত রায়।