Image default
ইতিহাস

শান্তিনিকেতন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্ন

শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের নিকট অবস্থিত একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তর-পশ্চিমাংশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়। ১৯১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এরপর ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর, (১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৮ পৌষ) রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন এখানে।

রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের দ্বিতীয়ার্ধের অধিকাংশ সময় শান্তিনিকেতন আশ্রমে অতিবাহিত করেছিলেন। তার সাহিত্য ও সৃষ্টিকর্মে এই আশ্রম ও আশ্রম-সংলগ্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের উপস্থিতি সমুজ্জ্বল। শান্তিনিকেতন চত্বরে নিজের ও অন্যান্য আশ্রমিকদের বসবাসের জন্য রবীন্দ্রনাথ অনিন্দ্য স্থাপত্যসৌকর্যমণ্ডিত একাধিক ভবন নির্মাণ করিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আশ্রমনিবাসী বিভিন্ন শিল্পী ও ভাস্করের সৃষ্টিকর্মে সজ্জিত হয়ে এই আশ্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থল হয়ে ওঠে। ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।

শান্তিনিকেতন ভবন
শান্তিনিকেতন ভবন আশ্রমের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ সালে এই বাড়িটি তৈরি করিয়েছিলেন। বাড়িটি দালান বাড়ি। প্রথমে একতলা বাড়ি ছিল। পরে দোতলা হয়। বাড়ির উপরিভাগে খোদাই করা আছে সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং মহর্ষির প্রিয় উপনিষদের এই উক্তিটি। তিনি নিজে বাড়ির একতলায় ধ্যানে বসতেন। তার অনুগামীরাও এখানে এসে থেকেছেন। কৈশোরে বাবার সঙ্গে হিমালয়ে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কিছুদিন বাস করেন। ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের সময়ও রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সপরিবারে এই বাড়িতে বাস করেন। পরে আর কখনও তিনি এটিকে বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করেননি। এখন বাড়িটির সামনে রামকিঙ্কর বেইজ নির্মিত একটি বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে। শান্তিনিকেতন ভবনের অদূরে একটি টিলার আকারের মাটির ঢিবি আছে। মহর্ষি এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতেন। একসময় এই টিলার নিচে একটি পুকুরও ছিল।

বেলুড় মঠ।

উপাসনা মন্দির
উপাসনা গৃহ বা ব্রাহ্ম মন্দির। ১৮৯২ সালে এই মন্দিরের উদ্বোধন হয়। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন থেকেই ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে প্রতি বুধবার সকালে উপাসনা হয়। মন্দির গৃহটি রঙ্গিনকাঁচ দিয়ে নান্দনিক নকশায় নির্মিত। আর তাই এস্থানিয় লোকজনের কাছে এটা কাচের মন্দির নামেও পরিচিত।

ছাতিমতলা
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রায়পুরের জমিদারবাড়িতে নিমন্ত্রন রক্ষা করতে আসছিলেন তখন এই ছাতিমতলায় কিছুক্ষণ এর জন্য বিশ্রাম করেন এবং এখানে তিনি তার “প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি” পেয়েছিলেন। তখন রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ষোলো আনার বিনিময়ে ২০বিঘা জমি পাট্টা নেন। বর্তমানে ৭ই পৌষ সকাল ৭.৩০ ঘটিকায় এখানে উপাসনা হয়। কিন্তু সেকালের সেই ছাতিম গাছ দুটি মরে গেছে। তারপর ঐ জায়গায় দুটি ছাতিম গাছ রোপণ করা হয়। সেই ছাতিম তলা বর্তমানে ঘেরা আছে সেখানে সাধারনের প্রবেশ নিশেধ। দক্ষিণ দিকের গেটে “তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি” এই কথাটি লেখা আছে।

তালধ্বজ
অনন্য সুন্দর গোলাকৃতির এই মাটির বাড়িটি শান্তিনিকেতন আশ্রমের সৌন্দর্যকে এক অন্য মাত্রা প্রদান করেছে। উপাসনা মন্দিরের ঠিক উত্তর-পূর্ব কোণে একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে একটি গোলাকার খড়ের চালের বাড়ি আছে। এটিকে তালধ্বজ বলা হয়। পূর্বে পাঠভবনের অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় তেজেশচন্দ্র সেন মহাশয় এখানে বসবাস করতেন। তেজশচন্দ্র সেন নামক এক বৃক্ষপ্রেমী এটির নির্মাতা॥

শান্তিনিকেতন

তিনপাহাড়
কাঁচ মন্দিরের ঠিক পূর্ব দিকে বিশাল বটগাছঘেরা জায়গাটির নাম তিন পাহাড়। শান্তিনিকেতনের প্রথম অবস্থায় এটি একটি পুকুর ছিল। পরবর্তীকালে পুকুরটি বন্ধ করে বাগান তৈরি করা হয়। এখানে মহর্ষির বসবার একটি বেদী ছিল। সূর্যদয়ের সনয় মহর্ষি এখানে বসে ধ্যানমগ্ন হতেন।

দেহলী
আম্রকুঞ্জের ঠিক দক্ষিণ কোণে একটি ছোট্ট দোতলা বাড়ি আছে সেটির নাম দেহলি। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর নামানুসারে এটি মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা নামে পরিচিত। দেহলির পাশে যে খড়ের বাড়িটি আছে তাকেই নতুন বাড়ি বলা হয়। নতুন বাড়ির পশ্চিম দিকে একটি খড়ের চালের বাড়ি আছে। সেটি শান্তিনিকেতন আশ্রমের মহিলাদের সমিতির ঘর, তার নাম ‘’আলাপিনী মহিলা সমিতি’।

নতুন বাড়ি
১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদারের কাছে ২০ বিঘা জমি গ্রহণ করার পর এখানে মাঝে মাঝে আত্মীয়-পরিজন সহ এসে ঈশ্বর উপাসনার জন্য এই দোতলা বাড়িটি তৈরি করান, এটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির অনুরূপে তৈরি।উপনয়নের পর প্রায় ১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন তখন এই বাড়িতেই ছিলেন। পরবর্তীকালে ৪০ বছর বয়সে যখন পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করেন তখন এই বাড়িতেই থাকতেন।বর্তমানে এটি হেরিটেজ বিল্ডি। শান্তিনিকেতন বাড়ির সামনে বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ এর একটি শিল্পকীর্তি। মূর্তিটির নাম “অনির্বাণ শিখা”। এই মূর্তিটির অর্থ এক জননী শান্তিনিকেতনকে শিশুরূপে কোলে তুলে ঈশ্বরের নিকট তাঁর মঙ্গল কামনা করেছেন। সকাল ও বিকাল রোদের ছায়া লম্বাভাবে পড়লে এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। রাত্রে আলো জ্বালালে বোঝা যায়।

শান্তিনিকেতন শিক্ষাকেন্দ্র
শান্তিনিকেতন শিক্ষাকেন্দ্র

বকুলবীথি
ছাতিমতলার ঠিক দক্ষিণ দিকের জায়গাটির নাম বকুলবীথি। এটি পাঠভবন এলাকার মধ্যে অবস্থিত। এখানে অনেক বকুল গাছ রয়েছে। তাই এই জায়গার নাম বকুলবীথি। এখানে প্রত্যেক গাছের নীচে কাঁকর বিছানা ও বেদী করা আছে। এখানে পাঠভবনের ক্লাস হয়। বকুলবীথি ছাড়িয়ে উত্তর দিকে এগোলে বামদিকে বিশ্বভারতীর “উদ্যান বিভাগ”।

আম্রকুঞ্জ
শান্তিনিকেতন বাড়ির দক্ষিণে অনেক আমগাছযুক্ত জায়গাটির নাম ‘আম্রকুঞ্জ’। এখানে যে বেদীটি আছে বর্তমানে সেখানেই ‘’বিশ্বভারতীর সমাবর্তন’’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং এই বেদীর আশপাশে কাঁকর বিছানো জায়গাগুলিতে পাঠ ভবনের ক্লাস হয়।

১৯১৩ সালে ১৩ নভেম্বর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কোলকাতা থেকে স্পেশাল ট্রেনযোগে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রনাথকে এই আম্রকুঞ্জেই আন্তরিক সম্বর্ধনা ও সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায় ও সুভাষচন্দ্র বসুকে এই আম্রকুঞ্জে সম্বর্ধনা দেওয়ার ব্যাবস্থা করেছিলেন।

উপাসনা গৃহ
১৮৯২ সালে এই মন্দিরের উদ্বোধন হয়। তখন থেকেই ব্রাম্ভ সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে প্রতি বুধবার সকালে উপাসনা হয়। এই উপাসনা বিশেষ কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপাসনা নয়। যে কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষই এই উপাসনায় যোগ দিতে পারেন। তবে উপাসনার আসতে হলে সাদা জামা কাপড় পরে মন্দিরে আসতে হবে।কোনো বিশিষ্ট ব্যাক্তির প্রয়াণে সন্ধ্যাবেলা এখানে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহর্ষির জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ঘণ্টাতলা
শান্তিনিকেতনের ছাত্র বিশিষ্ট খেলোয়াড় গৌরগোপাল ঘোষের নামানুসারে এই প্রাঙ্গণটির নামকরণ হয়েছে। এই প্রাঙ্গণের উত্তর পূর্ব কোণে সাঁচি স্তুপের প্রবেশদ্বার অনুকরণে একটি নির্মান আছে। এই বেদীর নামই পুরোনো ঘন্টাতলা। এখানে একটি বটবৃক্ষ আছে, বর্তমানে এখানে পাঠভবনের ছাত্র ছাত্রীদের ক্লাস নেওয়া হয়।

শমীন্দ্র পাঠাগার
১৯০৭ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, বসন্তপঞ্চমীতে কবির কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে, এখানেই ঋতুরঙ্গ নামে ঋতু উৎসবের সূচনা হয় যা 1930 এর দশকে কবির উদ্যোগে বসন্ত উৎসবে পরিণত হয়। শমী ঠাকুরের স্মৃতিতেই ভবনের নাম দেয়া হয় শমীন্দ্র পাঠাগার।

গৌরপ্রাঙ্গণ
গৌরপ্রাঙ্গণ মাঠের পশ্চিমদিকে একটি উন্মুক্ত পাকা মঞ্চ প্রায় ৩৫ বছর পূর্বে নির্মিত হয়েছে। একে কেউ কেউ গৌরসক বলে উল্লেখ করেন। এখানে বিশ্বভারতীর বহু অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই মঞ্চে বসন্ত উৎসবের সকাল ও সন্ধ্যার অনষ্ঠান ও ২৫শে বৈশাখের সমস্ত অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

প্রকৃতি ভবন
প্রকৃতি ভবন

সিংহসদন
দ্বিপেন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথের ইচ্ছে ফরাসি সাহেবের কুঠি কিনে নিয়ে ওখানে ব্রহ্ম বিদ্যালয় স্থাপন করা। তাঁরা দুজনে বড় ভাই নরেন্দ্র প্রসন্নর সিংহের কাছে ব্ৰহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের জন্য কুঠি বাড়ি বিক্রয়ের জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু নরেন্দ্র প্রসন্ন কুঠি বিক্রয়ের দাম ১১০০০/-টাকা ধার্য করেছেন। দ্বিপেন্দ্রনাথ এই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে বাড়ির জন্য দর দিলেন ৮০০০/- টাকা। নরেন্দ্র প্রসন্ন এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। দুর্ভাগ্য বশত আরো কথা বার্তা এগোবার আগেই ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বলেন্দ্রনাথ মাত্র ২৯ বছর বয়সে অকস্মাৎ মারা গেলেন।
এর ফলে শান্তিনিকেতন ভবনকে কেন্দ্র করে ব্ৰহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের চিন্তা ভাবনা কিছুদিনের জন্যে স্থগিত হয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে তাঁর পরিবার নিয়ে থাকতেন শিলাইদহে। রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্ম বিদ্যালয় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করলেন।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রবীন্দ্রনাথ এই অঞ্চলের কৃষক ও কৃষি সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানের জন্য আরেকটি ছোট প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উৎসাহী হলেন। তাঁর ইচ্ছে সুরুল গ্রামের কাছে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন। তিনি নরেন্দ্র প্রসন্নকে তাঁর কুঠিবাড়ি ও তৎসংলগ্ন জমি কেনবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।
নরেন্দ্র প্রসন্ন তখন ইংল্যান্ডে। টাকা শোধ না হওয়া পর্যন্ত বাৎসরিক ৬% সুদের বিনিময়ে নরেন্দ্র প্রসন্ন হ্যান্ডনোটের মাধমে বাড়ি ৮০০০/-টাকায় কবিকে বিক্রি করলেন। ফরাসি নীলকর সাহেব মন-লি-সিনরের কুঠিবাড়ি কবি কিনলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ এখানে স্থাপন করলেন পল্লী সংঠন কেন্দ্র। জায়গাটির নাম দিলেন শ্রীনিকেতন।
ছোট ভাই সত্যেন্দ্র প্রসন্ন এই গোপন লেনদেন সম্পর্কে জানতেন না। প্রায় ১৪ বছর বাদে (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে) তিনি যখন ঘটনাটি জানতে পারলেন, তিনি কবিকে সুদসহ (প্রায় ১০০০০/-টাকা ) ফেরত দিলেন। এবং সেই টাকাতে সিংহ সদন নির্মিত হল।

দ্বিজবিরাম
‘দ্বিজবিরাম’ বাড়িটির প্রথমে নাম ছিল ‘নিচু বাংলা’। ক্রমে বাড়িটির নাম থেকে এলাকাটির নাম নিচুবাংলা হয়ে গেল। ‘নিচু বাংলা’ বাড়িটি শান্তিনিকেতনের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে ‘আশ্রম’ পর্বে নির্মিত হয়েছিল আশ্রম সীমার বাইরে। এখানে ঠাকুরবাড়ির লোকেরা মাঝে মাঝে বাস করতেন। শান্তিনিকেতন আশ্রম এলাকায় আমিষ ভোজন নিষিদ্ধ, এজন্য এই বাড়িতে আমিষ রান্না হতো। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িতে বহুকাল বাস করেছেন। পরবর্তীকালে ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু পর, তাঁর স্মরণে উক্ত বাড়িটির নামকরণ হয় ‘দ্বিজবিরাম’।
সম্প্রতি বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ এই বাড়িটিতে ধ্যানকক্ষ এবং যোগ শিক্ষা কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সাধু উদ্যোগ।

কালোবাড়ি
মাটির বাসা-র দিকে চিরকাল রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ভাললাগা ছিল। অথচ বাদ সাধত শান্তিনিকেতনের বর্ষা, তাঁরই প্রিয় ঋতু। ১৯৩৫-এ মাটির বাসা ‘শ্যামলী’ তৈরি হয়। পরের শ্রাবণে প্রবল বর্ষণে ভেঙে গিয়েছিল সে বাড়ি। শ্যামলীর কাছাকাছি সময়েই তৈরি শুরু হয় কলাভবনের ছাত্রাবাস কালোবাড়ির। নন্দলাল বসুর পরিকল্পনায় আশ্চর্য সেই বাড়ির দেওয়ালে মহেঞ্জোদড়ো থেকে মিশরীয় সভ্যতার শিল্পের ছবি। কিন্তু অনেকটা যখন এগিয়ে গিয়েছে কাজ, তখন বিশ্বভারতীর আর্থিক অনটনের দিনে তৈরি আর রক্ষণাবেক্ষণের কথা ভেবে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর সুরেন্দ্রনাথ কর কবিকে অনুরোধ করেছিলেন সে বাড়ি তৈরি বন্ধ করে দিতে। একরকম রাজি হয়েও একবার কী কাজ চলছে সে বাড়িতে, দেখতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর তার পরেই আমূল মতবদল। বন্ধ করা তো দূরস্থান, কাজে নন্দলালকে আরও উৎসাহ দিয়ে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। এমনই সব উজ্জ্বল ঘটনা আর ইতিহাস জড়িয়ে আছে কালোবাড়ির সঙ্গে। সে সব নিয়ে কিছু লেখা আর বহু ছবি সহ কলাভবনের উদ্যোগে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ থেকে প্রকাশিত হল দ্বিভাষিক একটি সংকলন ব্ল্যাক হাউস কালো বাড়ি। সম্পাদনা করেছেন সঞ্জয়কুমার মল্লিক। আলোকচিত্র ও গ্রন্থনির্মাণে অর্ণব ঘোষাল।

উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণ
শান্তিনিকেতনের আশ্রমের উত্তরদিকে অবস্থিত একটি এলাকাকে ‘উত্তরায়ন’ বলে। মূলত পাঁচটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে উত্তরায়ণ প্রাঙ্গন। বাড়ি পাঁচটি হলো- কোনার্ক, উদয়ন, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদীচী। এছাড়াও এখানে রয়েছে চিত্রভানু-গুহাঘর এবং বিচিত্রা বাড়ি।

শান্তিনিকেতনের কোনার্ক ভবন
শান্তিনিকেতনের কোনার্ক ভবন

কোনার্ক
উত্তরায়ণের শিমূল গাছের পাশে বাড়িটির নাম ‘কোনার্ক’। উত্তরায়ণ এলাকার মধ্যে প্রথম দু’টি পর্ণকুটির তৈরী হয়েছিল। তারই একটি পরিবর্তিত হয়ে তৈরি হয় ‘কোনার্ক’ বাড়ি। প্রথমে ছিল খড়ের চাল। পরে পাকা করা হয়। ‘কোনার্ক’ বাড়ির ঘরগুলি কোনোটির মেঝে উঁচু, আবার কোনোটির মেঝে নিচু।.

উদয়ন
এই বাড়িটি নানা সময়ে নানা ভেঙে গড়ে আজকের রূপ পেয়েছে ‘উদয়ন’। বাড়িটির ভিতরে কাঠের কারুকাজ করা। চারিদিকে বসার জায়গা এবং মাঝখানে ফাঁকা। শীতলপাটি দিয়ে ভিতরের দেওয়ালগুলি ঢাকা আছে। ঘরের ভিতরের নক্সা কবিগুরুর নিজের

শ্যামলী
উত্তরায়নের কোনার্কের পূর্বদিকে মাটির বাড়িটি ‘শ্যামলী। বাড়ির দেওয়াল ও ছাদ মাটির। কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা শ্যামলীর দেওয়ালে বহু মূর্তি গড়েছে। প্রবেশ পথের দু’পাশে রামকিঙ্কর বেজের তৈরি অসামান্য কীর্তি ‘সাঁওতাল-সাঁওতালনী’ স্থাপত্য রয়েছে। গান্ধীজী, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, বিনোবা ভাবে, মাদার টেরেজা সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই বাড়িতে থেকেছেন।

পুনশ্চ
কবির ইচ্ছাতেই শ্যামলীর পূর্বদিকে ‘পুনশ্চ’ বাড়িটি গড়ে ওঠে। এই বাড়ির দেওয়াল মাটির এবং ছাদ কংক্রিটের। মাঝখানে একখানি ঘর এবং চারিদিকে খোলা বারান্দা। পরে বারান্দাটি কাঁচ দিয়ে ঘেরা হয়। শ্যামলীকে কবি বলেছিলেন তাঁর জীবনের শেষ বাড়ি। কিন্তু পুনরায় এই বাড়ি তৈরি হলো বলে এই বাড়ির নাম রাখা হল ‘পুনশ্চ’।

উদীচী
পুনশ্চের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের দোতালা বাড়িটি হল ‘উদীচী’। পুনশ্চতেও কবি বেশিদিন থাকতে পারলেন না। আবার তৈরি করলেন উদীচী। এটাই কবির শেষ বাড়ি। প্রথমে এই বাড়ির নামকরন হয় ‘সেঁজুতি’, পরে উত্তর দিকের বাড়ি বলে নামকরন হয় ‘উদীচী’।

পৌষ উৎসব
পৌষমেলা বা পৌষ উৎসব হল শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন অঞ্চলের প্রধান উৎসব।দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ স্মরণে এই উৎসব পালিত হয়। উৎসব ও মেলা শুরু হয় প্রতি বছর ৭ পৌষ; চলে তিন দিন ধরে।

বসন্তোৎসব
শান্তিনিকেতনে সুশৃঙ্খল আনন্দগান ও নাচের অনুষ্ঠান। সকালে সবাই গাইছে, ‘‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল …।’’ ধর্মের ছুঁতমার্গ, সামাজিক বিধিনিষেধ বা লোকাচারের বাড়াবাড়ি— এর কিছুই আসতে পারেনি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে, শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবে। এই উৎসব এখনও আন্তরিক, এখনও অমলিন আনন্দের উৎস।

১৯০৭ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, বসন্তপঞ্চমীতে, শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে, যে ঋতু উৎসবের সূচনা হয়, তারই পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত রূপ শান্তিনিকেতনের আজকের এই বসন্ত উৎসব বা বসন্তোৎসব। সরস্বতীর পূজার দিন শুরু হলেও পরবর্তী কালে সে অনুষ্ঠান বিভিন্ন বছর ভিন্ন ভিন্ন তারিখ ও তিথিতে হয়েছে। শান্তিনিকেতনের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথের বিদেশযাত্রা বা অন্য আরও দিক মাথায় রেখে কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে আশ্রমবাসী মিলিত হতেন বসন্তের আনন্দ অনুষ্ঠানে।

শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতন

 

যোগাযোগ
শান্তিনিকেতন যেতে রেলপথ ও সড়কপথ একমাত্র মাধ্যম।
রেলপথে
এখানে ২টি রেলস্টেশন রয়েছে। দক্ষিণভাগে বোলপুর শান্তিনিকেতন রেলওয়ে স্টেশন ও উত্তরভাগে প্রান্তিক। দুটি স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সম দূরত্বে অবস্থিত। বোলপুর তুলনামূলক ব্যাস্ততম স্টেশন।
শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস প্রতিদিন হাওড়া ১২ নং প্লাটফর্ম থেকে ১০:১০ এ ছাড়ে। বোলপুর পৌঁছায় ১২:৩০ এ। ঐদিন বোলপুর থেকে দুপুর ১:১০ এ ছাড়ে। হাওড়া বিকেল ৩:৪০ এ পৌঁছায়।

বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭ – ১৯০৫) – ব্রাহ্ম শীর্ষনেতা ও জমিদার। ১৮৬৩ সালে শান্তিনিকেতনের গোড়াপত্তন করেন।

  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ – ১৯৪১) – দিকপাল বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, সংগীতস্রষ্টা ও দার্শনিক। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, কালক্রমে যা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ ধারণ করে।
  • অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১ – ১৯৫১) – প্রবাদপ্রতিম চিত্রকর ও ভাস্কর। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ।
    ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় – ধর্মতত্ত্ববিদ, ব্রহ্মবিদ্যালয়ের স্বল্পকালীন শিক্ষক।
  • জগদানন্দ রায় – বিশ্বভারতীর গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষক।
  • বিধুশেখর শাস্ত্রী – সংস্কৃত পণ্ডিত, বিশ্বভারতীর বিশিষ্ট গবেষক।
  • হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় – বঙ্গীয় শব্দকোষ গ্রন্থের প্রণেতা, শান্তিনিকেতনে বাংলা ও সংস্কৃতের শিক্ষক।
    ক্ষিতিমোহন সেন – বিশিষ্ট ভারততত্ত্ববিদ। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে একাধিক ভারতীয় ভাষা শিক্ষা করে বাংলা ও ভারতের লোকসাহিত্যের নানা নিদর্শন পুনরুদ্ধার করেন।
  • শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু (১৮৮২ – ১৯৬৬) – বিশিষ্ট চিত্রকর ও ভাস্কর। শান্তিনিকেতনের অলংকরণে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল।
  • সুরেন্দ্রনাথ কর – বিশিষ্ট চিত্রকর। শান্তিনিকেতনের অঙ্কন শিক্ষক। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি বাড়ির নকশা অঙ্কন করেছিলেন।
  • রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর – রবীন্দ্রনাথের জ্যৈষ্ঠ পুত্র। বিশিষ্ট স্থপতি ও কৃষিবিজ্ঞানী। রবীন্দ্র-কীর্তি সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
  • প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় – বিশ্বভারতীর অধ্যাপক। রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ রবীন্দ্রজীবনী–র রচয়িতা। রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক আরও অনেক গ্রন্থও।

Related posts

অবাক করা এক সঙ্গীতের যাদুকর-সংগীতশিল্পী তানসেনের জীবনী

News Desk

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও শেষ জন্মদিন

News Desk

যেভাবে একুশ পেয়েছিল বিশ্বস্বীকৃতি

News Desk

Leave a Comment