Image default
ইতিহাস

বাংলার বীরাঙ্গনা ‘রায়বাঘিনী’ ভবশঙ্করী রায়

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির কাছে রানী ভবশঙ্করী নামটা ততটা পরিচিত নয়। কিন্তু রানী ভবশঙ্করী অবিভক্ত বাংলার মুসলমান শাসকদের কাছে একটা আতঙ্ক ছিল, যাকে বাংলার সুলতানি শাসক, পাঠান শাসকরা কোনোদিন পরাজিত করতে পারেনি। এমনকি রানী ভবশঙ্করীর শাসনকালে মুঘল শাসক আকবর ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন। মিলিন্দ চক্রবর্তী দাদার অনুরোধ রাখতে তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জেনে নিই।

রানী ভবশঙ্করীর জন্মসূত্রে নাম ছিল ভবশঙ্করী চৌধুরী। তাঁর জন্ম হয়েছিল ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যে, সেই সময় ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য বর্তমান হাওড়া ও হুগলি জেলা জুড়ে ছিল। তাঁর পিতার নাম দীননাথ চৌধুরী। তিনি রাজা রুদ্রনারায়ণের সাম্রাজ্যে একজন দুর্গরক্ষক ছিলেন। তাঁর পিতা দীনানাথ চৌধুরী দুর্গের রক্ষক ছিলেন, সেইসঙ্গে সেনাদের যুদ্ধ বিদ্যার প্রশিক্ষণ দিতেন। আর তাই ছোটবেলা থেকেই ভবশঙ্করী পিতার কাছে অস্ত্র শিক্ষা পান। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা, তরোয়াল যুদ্ধ, তীর ছোঁড়া ইত্যাদির প্রশিক্ষণ নেন। সেইসঙ্গে তিনি মাঝে মাঝে পিতার সঙ্গে যুদ্ধ অভিযান এবং শিকার অভিযানে যেতেন।এছাড়াও ভবশঙ্করী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতদের কাছ থেকে সমাজশাস্ত্র, রাজনীতি, দর্শন, কূটনীতি এবং ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।

এইভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এর কিছু সময় পরেই ভবশঙ্করীর মায়ের মৃত্যু হয়। তারপরেই দীনানাথ তাঁর কন্যার বিবাহ দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু স্বাধীনচেতা, যোদ্ধা ভবশঙ্করী এক অদ্ভুত শর্ত দেন যে যে পুরুষ তাকে তরোয়াল যুদ্ধে হারাতে পারবেন তিনি তাকেই বিয়ে করবেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। কারণ সময়ের ফেরে ভবশঙ্করীর সঙ্গে রাজা রুদ্রনারায়ণ-এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এ নিয়ে আজও হাওড়া এবং হুগলী জেলার গ্রামে-গ্রামে লোকমুখে কাহিনী প্রচলিত আছে, একবার ভবশঙ্করী শিকার অভিযানে গিয়েছিলেন। সেখানে একদল বুনো মহিষ ভবশঙ্করীকে আক্রমণ করে। কিন্তু ভবশঙ্করীর তরোয়াল চালানোয় অসাধারণ দক্ষতা ছিল। সেই দক্ষতায় সবকটি বুনো মহিষকে তিনি হত্যা করেন এবং শিকার অভিযানে থাকা বাকিদের রক্ষা করেন। এই দৃশ্য রাজা রুদ্রনারায়ন দূর থেকে লক্ষ্য করেন এবং যুদ্ধ দক্ষতায় মুগ্ধ হন। তিনিই ভবশঙ্করীর পিতাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন এবং খুব শীঘ্রই তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয় গড় ভবানীপুর দুর্গের কাছে দামোদর রাজপ্রাসাদে। এরপরেই ব্রাহ্মণ কন্যা ভবশঙ্করী চৌধুরী পরিচিত হন রানী ভবশঙ্করী নামে।

 রানী ভবশঙ্করী
ছবি: quora.com

বিবাহের পরেই রানী ভবশঙ্করী রাজ্য শাসন বিষয়ে রাজা রুদ্রনারায়নকে সাহায্য করতেন। একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো রানী ভবশঙ্করী দেবী চন্ডীর ভক্ত ছিলেন। সেই কারণে বিবাহের পরেই রাজপ্রাসাদের পাশেই দেবী চন্ডীর মন্দির নির্মাণ করান। তিনি রোজ নিষ্ঠাভরে মা চন্ডীর পূজা করতেন। আজও হাওড়া ও হুগলী জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যে বেতাই চন্ডী এবং মেলাই চন্ডীর পূজা হয়ে থাকে, তা ভবশঙ্করীর শাসনকালেই হিন্দুদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দেবী চন্ডীর অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করেন।

এছাড়াও তিনি সাম্রাজ্যের সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দেন। রানী ভবশঙ্করী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অনেকগুলো সামরিক দুর্গের নির্মাণ করেন। তিনি খানাকুল, ছাউনপুর, তমলুক, আমতা , উলুবেড়িয়া, নস্করডাঙ্গায় দুর্গ নির্মাণ করেন। সেই সঙ্গে রাজ্যের সামরিক প্রশিক্ষণের বিষয়টিও দেখভাল করতেন। তাঁর নজরদারির মধ্যেই অনেকগুলি সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হতো। তিনিই প্রথম ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে মহিলাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন।সেই সঙ্গে তিনি নিয়ম করেন যে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের একজনকে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিতে হবে, যাতে আপদকালীন পরিস্থিতিতে সেনার দরকার পড়লে যুদ্ধ যোগ দিতে পারে। রানী ভবশঙ্করীর প্রশাসনিক দক্ষতায় ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য হাওড়া ও হুগলী ছাড়িয়ে পূর্ব বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিন মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অংশে বিস্তার লাভ করে। সেই সঙ্গে তিনি নৌবাহিনীর দিকেও নজর দেন।রানী ভবশঙ্করীর তত্ত্বাবধানে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের নিজস্ব নৌবাহিনী গঠন করেন, যা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল।

বাংলার বীরাঙ্গনা 'রায় বাঘিনী' ভবশঙ্করী রায়
ছবি: hatpakha.com

সেইসময় গৌড়ের শাসক ছিলেন পাঠান বংশীয় সুলেমান কারী। মুসলিম শাসকদের লুটেরা বাহিনী ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অতর্কিত হামলা করার লুঠ-পাট চালাতো। তাই এদের শায়েস্তা করতে রানী ভবশঙ্করীর পরামর্শে উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবের সঙ্গে জোট করেন রাজা রুদ্রনারায়ন । ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেনির যুদ্ধে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য এবং মুকুন্দদেবের মিলিত সেনাবাহিনী গৌড়ের সুলতান সুলেমান কারীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুকুন্দদেবের সেনাপতি রাজীবলোচন রায়, যিনি কালাপাহাড় নামে বিখ্যাত। সুলেমানের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র দাউদ খান গৌড়ের শাসক হন। তিনি মুঘলদের পরাজিত করার জন্যে রাজা রুদ্রনারায়নের সাহায্য চান। রুদ্রনারায়ন রাজি না হলে দাউদ খান তাঁর সেনাপতি কলটু খানকে ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য আক্রমণের নির্দেশ দেন । রুদ্রনারায়নের সেনাবাহিনী কলটু খানের সেনাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে এবং হত্যা করেন। এইযুদ্ধে বিশাল সংখক পাঠান সেনার মৃত্যু হয়। এরফলে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুসলিম শাসনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।

এর পরেই রানী ভবশঙ্করী এক পুত্র সন্তান প্রতাপনারায়নের জন্ম দেন। প্রতাপনারায়নের বয়স যখন ৫ বছর, তখন রাজা রুদ্রনারায়নের মৃত্যু হয়।রাজা রুদ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর রানী ভবশঙ্করী মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। তিনি মানসিক দিক থেকে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে তিনি রাজা রুদ্রনারায়ণের চিতায় নিজেকে আহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

কিন্তু ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্ বংশের কুল পুরোহিত রানী ভবশঙ্করীকে বাধা দেন। রাজ পুরোহিত রানী ভবশঙ্করীকে রাজ্যের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান, যতদিন না পর্যন্ত রাজকুমার প্রতাপনারায়ণ প্রাপ্তবয়স্ক না হয়ে ওঠেন। তার পরেই রানী ভবশঙ্করী রাজ্যের শাসনভার সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শাসনভার গ্রহণ করার পূর্বে রাজ্যের সভাসদদের কাছে তিন মাস সময় চেয়ে নেন নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্যে। এরপরে তিনি তাঁর রাজ্যের দায়িত্বভার সেনাপতি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী এবং রাজস্ব মন্ত্রী দুর্লভ দত্তের ওপর ছেড়ে দিয়ে কাস্তাসনগড়-এর মহাদেব মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
তিনি পাঠান আক্রমণের সম্ভাবনা মাথায় রেখে তাঁর সঙ্গে খুবই বিশ্বস্ত এবং শক্তিশালী মহিলাদের একটি সেনাদলকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মহাদেব মন্দিরে তিনি রোজ নিষ্ঠাভরে পূজা করতেন এবং সেইসঙ্গে গরিব-দুঃখী, ভিখারিদের অর্থ, অন্ন-বস্ত্র দান করতেন।

কিন্তু তাঁর অবর্তমানে সেনাপতি চতুর্ভুজ চক্রবর্তী রাজ্যের ক্ষমতা দখলের জন্যে সচেষ্ট হলেন। সেনাপতি চতুর্ভুজ সুলতান ওসমান খানের সঙ্গে চক্রান্ত করেন রানী ভবশঙ্করী এবং তাঁর নাবালক পুত্র প্রতাপনারায়ণকে হত্যা করার। সেইমতো চতুর্ভুজ সমস্ত তথ্য ওসমান খানের কাছে পৌঁছে দেন। ওসমান খান তাঁর সেনাবাহিনীর বাছাইকরা শক্তিশালী সেনা নিয়ে রানী ভবশঙ্করীকে হত্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী ওসমান খানের সেনারা হিন্দু সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যে প্রবেশ করেন। এছাড়াও বহু পাঠান সৈন্য ব্যবসায়ী, পর্যটক, ফকির ইত্যাদি ছদ্মবেশে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যে প্রবেশ করেন। কিন্তু বর্তমান হাওড়া জেলার আমতার দুর্গে থাকা সেনা ইউনিটের গোয়েন্দারা পাঠান সেনাদের চিনতে পারেন। তারাই রানী ভবশঙ্করীকে পাঠান সেনার আগমনের খবর পৌঁছে দেন।

রানী ভবশঙ্করী এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই পাঠান সেনাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। সেই মতো তিনি আশেপাশের দুর্গগুলি থেকে দক্ষ সেনাদের ডেকে নেন এবং তাদেরকে আশেপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বলেন। তিনি নিজের সঙ্গে বিস্বস্ত নারী সেনাদের রাখেন। রাতে রানী ভবশঙ্করী যুদ্ধের পোশাক পরে, অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পূজায় বসেন। পূজায় বসার সময় তিনি নিজের শরীরে একটি সাদা কাপড় জড়িয়ে নেন। গভীর রাতে ওসমান খানের সেনাবাহিনী রানী ভবশঙ্করীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মন্দিরে আক্রমণ করেন। কিন্তু সেনারা প্রস্তুত থাকায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রানী ভবশঙ্করীর নেতৃত্বে থাকা সেনারা পাঠান সেনাদের খণ্ডবিখণ্ড করেন। পিছনে থাকা পাঠান সেনাদের একটি দল এই খবর পাওয়ার পর ভোরের সময়ে কিছু দূরের গ্রামে থাকা একটি শৈব সাধুদের আখড়ায় আক্রমণ করেন। কিন্তু শৈব সাধুরা পাঠানদের তরোয়ালের জবাব তরোয়ালের দ্বারাই দেন। সেখানে শৈব সন্ন্যাসীরা বহু পাঠান সৈন্যকে হত্যা করেন। ওসমান খান রাতের অন্ধকারে পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচান। পরেরদিনই রানী ভবশঙ্করী নিজের রাজধানী গড় ভবানীপুরে ফিরে আসেন। তিনি গোয়েন্দা মারফত খবর পেয়েছিলেন চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর চক্রান্তের কথা। কিন্তু প্রমানের অভাবে তাকে কোনো শাস্তি দিতে পারেননি। কিন্তু এরপরেই রাজ্যের শাসনভার সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন রানী ভবশঙ্করী।

দায়িত্ব নিয়েই তিনি চতুর্ভুজ চক্রবর্তীকে সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেন এবং ভূপতি কৃষ্ণ রায়কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সেনা প্রশিক্ষণের শিবির স্থাপন করেন, যেগুলি রানী ভবশঙ্করী নিজে তদারকি করতেন। এরপরেই পাঠান সেনাদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা, বাঘের মতো ক্ষিপ্রতায় তাঁর যুদ্ধ করার কাহিনী ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যের লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। যদি রানী ভবশঙ্করী বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ না করে ওসমান খানকে পরাজিত করতেন, তাহলে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্য ইসলামের শাসন শুরু হতো এবং হিন্দুর মঠ-মন্দির, হিন্দুর সংস্কৃতি, সুখ-শান্তি সব ধ্বংস হয়ে যেত।

এর কিছুদিন পরেই রানী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেকের দিনক্ষণ স্থির হয়। ঠিক হয় যে এক বিশেষ দিনে তান্ত্রিক মতে ছাউনাপুরের অন্তর্গত বাঁশুরি গ্রামের ভবানী মন্দিরে রানী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেক হবে। স্থির হয় যে গোলক চট্টোপাধ্যায় নামক একজন তান্ত্রিক রাজ্যাভিষেকের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন।

কিন্তু পদচ্যুত সেনাপতি চতুর্ভজ চক্রবর্তী চক্রান্ত করতে থাকেন রানী ভবশঙ্করীকে হত্যা করে ভূরিশ্রষ্ঠ রাজ্যের ক্ষমতা দখলের। এবারেও তিনি পাঠান সেনাপতি ওসমান খানের সঙ্গে হাত মেলান। এবারে চতুর্ভুজ চক্রবর্তী, ওসমান খানকে প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর অনুগত সেনাদের নিয়ে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্যে আক্রমণ করবেন। পরিকল্পনা মতো ওসমান খান কয়েকশো সেনা নিয়ে রাতের অন্ধকারে খানাকুলে এসে পৌঁছান। খানাকুলে এসে জঙ্গলে ঘাঁটি গাড়েন। কিন্তু জঙ্গলে শিকার করতে যাওয়া এক শিকারী এদের দেখতে পেয়ে খানাকুলের দুর্গে খবর দেন। সেই খবর যখন চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর কাছে পৌঁছায়, তিনি তা গুজব বলে উড়িয়ে দেন( ওই সময় সেনাপতি ভূপতি কৃষ্ণ রায় বিশেষ কাজে দূরে থাকায় চতুর্ভুজ চক্রবর্তী খানাকুল দুর্গের দায়িত্বে ছিলেন)।

কিন্তু রানী ভবশঙ্করীর গুপ্তচর ব্যবস্থা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, এই খবর তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। খবর পাওয়ার সঙ্গেই তিনি ব্যবস্থা নেন। তিনি দূতের মাধ্যমে ভূপতি কৃষ্ণ রায়কে ফিরে আসতে বলেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দুর্গে থাকা সেনাদেরকে ডেকে নেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রানী ভবশঙ্করী নিজের রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে সেনাবাহিনীকে রাজ্যের সীমান্ত বরাবর সেনাকে ছড়িয়ে রাখতেন। সেই জন্যে রাজধানীতে কখনো বেশি সংখক সেনা থাকতো না। তিনি রাজ্যের সীমানা বরাবর নির্দিষ্ট দূরত্বে বহু দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রতিটি দুর্গে একটি করে সেনা ইউনিট থাকতো। এছাড়াও প্রতিটি দুর্গে অশ্বারোহী সৈন্য, হস্তী বাহিনী এবং পদাতিক সৈন্য থাকতো। সেই কারণে রানী ভবশঙ্করী ছাউনাপুর, বাঁশডিঙ্গাগড় এবং লস্করডাঙ্গা দুর্গের সেনা ইউনিটগুলোকে নিজের কাছে ডেকে নেন এবং তাদেরকে আশেপাশের এলাকায় মোতায়েন করেন। সেই সঙ্গে রানী ভবশঙ্করী তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হরিদেব ভট্টাচার্যের পরামর্শে আশেপাশের বাগদি(বর্গ ক্ষত্রিয়) এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বাছাই করা যোদ্ধাদের সামিল করেন, যারা তীর ছোঁড়া এবং তরোয়াল চালানোয় বিশেষ দক্ষ ছিলেন। তাছাড়া, তাদের পূর্বেই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল, যেহেতু রানী ভবশঙ্করী রাজ্যের প্রত্যেক পরিবারের একজনের সেনা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছিলেন।

বাংলার বীরাঙ্গনা 'রায়বাঘিনী' ভবশঙ্করী রায়
ছবি: indiarag.in

পাঠান সেনাপতি ওসমান খানের নেতৃত্বে পাঠান সেনাবাহিনী এবং বিশ্বাসঘাতক চতুর্ভুজ চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকা সেনাবাহিনী একসঙ্গে বাশুড়িতে আক্রমণ করেন। কিন্তু রানী ভবশঙ্করীর সেনাবাহিনী পূর্বেই প্রস্তুত ছিল ।ফলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দুই বাহিনীর মধ্যে। রানী ভবশঙ্করী নিজেই এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। রানী ভবশঙ্করীর সৈন্যরা যাদেরকে তিনি নিজে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, ক্ষিপ্রতার সাথে পাঠান সৈন্যদেরকে খণ্ডবিখণ্ড করেন। সমসাময়িক পাওয়া সূত্র অনুযায়ী, রানী ভবশঙ্করী নিজে হাতির পিঠে চেপে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এই যুদ্ধে বাগদি ও চন্ডাল সেনারা অসীম বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কয়েক ঘন্টার যুদ্ধে পাঠান সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং পাঠান সেনাপতি ওসমান খান পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন। পরে তিনি ফকিরের ছদ্মবেশে উড়িষ্যা পালিয়ে যান। এই যুদ্ধের পরে রানী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয়।

রানী ভবশঙ্করীর বীরত্বের কথা, পাঠান সেনাদের ধূলিসাৎ করার কথা মুঘল সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছায়। এই খবর আকবরের কাছে পৌঁছনোর পর আকবর ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এর পিছনেও কারণ ছিল। সেই সময় অবিভক্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা- যাকে সুবে বাংলা বলা হতো, তার সুবেদার ছিলেন মান সিংহ। কিন্তু সেই সময়ে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন অংশে পাঠানদের অত্যাচার ছিল খুব। পাঠানরা মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রে হামলা ও লুটপাট চালাতো। এ নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন আকবর কারণ বাংলা সেসময় ছিল সোনার বাংলা। কিন্তু রানী ভবশঙ্করী অসাধারণ রণকৌশল ও বীরত্বে সেই পাঠান সৈন্যদের পরাজিত করেছিলেন। ফলে আকবর ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যে মান সিংহকে পাঠান। মান সিংহ ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। সেইসঙ্গে আকবর ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন। মুঘল সম্রাট আকবর রানী ভবশঙ্করীকে ‘রায়বাঘিনী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর অনেক বছর রানী ভবশঙ্করী রাজ্য শাসন করেন।

পরে তাঁর পুত্র প্রতাপনারায়ন প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাঁর হাতে রাজ্যের ভার দেন এবং তিনি কাশীতে চলে যান। আজও হাওড়া জেলার উদনারায়নপুরে রানী ভবশঙ্করী প্রতিষ্ঠিত রায়বাঘিনী মন্দির রয়েছে। আজও গড় ভবানীপুর রয়েছে।

তথ্য সূত্র: কোয়ারা, উইকিপিডিয়া

Related posts

কৃষির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে কৃষি জাদুঘর

News Desk

বিশ্বের প্রথম প্লেন চুরি কিভাবে হয়েছিল?

News Desk

জাতিসংঘে জাতির জনকের মহৎকণ্ঠ

News Desk

Leave a Comment