Image default
ইতিহাস

গিউলিয়া টোফানা: ৬০০ পুরুষকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছেন যে নারী

সময়টা ১৬৫০ সাল। ইতালির পালের্মোতে রৌদ্রোজ্জ্বল এক দিনে নিজের স্বামীকে এক বাটি স্যুপ পরিবেশন করতে গিয়েছিলেন জনৈক নারী। স্বামীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে স্যুপভর্তি বাটিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে হঠাৎ হৃদয়ে পরিবর্তন আসে, স্বামীকে বারবার নিষেধ করতে থাকেন স্যুপের বাটি মুখে তুলতে!

ফলে সন্দেহ আরও বেড়ে যায় স্বামীর মনে। বাটির স্যুপে ঠিক কী সমস্যা তা স্বীকার না করা পর্যন্ত স্ত্রীকে অত্যাচার করতে থাকেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে বিষ মেশানোর কথা স্বীকার করেন ওই নারী। আর এতেই বেরিয়ে আসে সপ্তদশ শতকে রোমের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ খুনীর নাম, যিনি কিনা খুন করেছেন ৬০০ পুরুষকে!

সপ্তদশ শতকে ইতালীয় সমাজে নারীদের মর্যাদা ছিল না বললেই চলে। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো সুযোগও তাদের দেওয়া হতো না। তারা বিয়ে করতেন স্বামীর কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসা ও সুন্দর আচরণ পাওয়ার আশায়, কিন্তু এমনটা খুব কমই হতো। এর বাইরে হয় একাকী জীবন এবং যৌনকর্মীর পেশা বেছে নিতে হতো; কিংবা বিধবা হয়ে দিন পার করতে হতো। শেষোক্ত ব্যবস্থাটিই অধিকাংশ নারীর কাছে কাঙ্ক্ষিত পথ হিসেবে বিবেচিত ছিল।

কিন্তু বিধবা হতে চাইলেই যে যখন-তখন তা সম্ভব নয়, সে তো পাঠকমাত্রই বুঝতে পারছেন। তাই তৎকালীন রোমে তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল একটি ‘ক্রিমিনাল ম্যাজিক্যাল আন্ডারওয়ার্ল্ড’, যারা নারীদেরকে তাদের স্বামীদের খুন করার কাজে সাহায্য করত! এই অন্ধকার জগতের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রসায়নবিদ, ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং কালো জাদু চর্চাকারীরা।

অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নারীদের কাছে সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা। আর ‘বিষ’কে যদি নারীর অস্ত্র ধরা হয়, তাহলে ইতালির গিউলিয়া টোফানার চাইতে বেশি কার্যকরীভাবে কেউ তা ব্যবহার করতে পারেনি বলা যায়। ইতালির রেঁনেসা যুগে ‘অ্যাকুয়া টোফানা’ নামক মারাত্মক শক্তিশালী ও চিহ্নহীন বিষ তৈরির জননী ছিলেন এই নারী।

বিবাহিত নারীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল গিউলিয়ার তৈরি বিষ। অত্যাচারী স্বামীর নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে গিউলিয়ার শরণাপন্ন হতেন তারা।

সিসিলি, নেপলস ও রোমজুড়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড জগতের যে নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে ছিল, গিউলিয়া টোফানা ছিলেন তার প্রধান নেতা। ১৬৩০ থেকে ১৬৫৫ সালের মধ্যে কালোবাজারে এ জাতীয় বিষের চাহিদা খুব বেড়ে যায়। ফলে একচেটিয়া ব্যবসা করতে থাকেন টোফানা। তার অন্ধকার রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ধূর্ত নারী, গোপন চিকিৎসক, অসাধু পাদ্রী এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারা ডাইনিরা। তারা সবাই মিলে বিষ বিক্রি ও বন্টনের কাজে নিবেদিত ছিলেন।

দীর্ঘকাল ইতিহাসের অন্ধকারে থাকা নারী, গিউলিয়া টোফানাকে কেউ কেউ মনে করেন একজন সিরিয়াল খুনী; আবার অনেকের মতে, তিনি একজন মোহাবিষ্টকারী ঘাতক। কিন্তু সত্যটা ছিল আরও বেশি ভয়াবহ!

গিউলিয়ার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ইতিহাসে খুব বেশি জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয়, তিনি একজন অত্যাচারী বাবার সঙ্গে বসবাস করতেন। গিউলিয়াকে ইতিহাসের পাতায় একজন সুন্দরী নারী হিসেবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মা-বাবার মৃত্যুর পর অনেকটা সময় তিনি ওষুধ প্রস্তুতকারক চিকিৎসকদের সাথে সময় কাটান এবং তারই ফলশ্রুতিতে একদিন নিজেই বিষ আবিষ্কার করেন।

গিউলিয়া নিজেও বিধবা হওয়ার পর নিজের মেয়েকে নিয়ে প্রথমে সিসিলি থেকে নেপলসে এবং নেপলস থেকে রোমে চলে আসেন। এভাবে তিনটি অঞ্চলেই তার কালোবাজারি ব্যবসা বিস্তৃত হয়। স্বামীর ভালোবাসাহীন, নির্মম সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে থাকা নারীদের প্রতি স্নেহ দেখিয়ে ‘মুক্তির উপায়’ হিসেবে তাদের হাতে বিষ তুলে দিতেন গিউলিয়া।

নিজের মেয়ে, একদল বিশ্বস্ত সহযোগী এবং খুব সম্ভবত একজন পুরোহিতের সাহায্যে গিউলিয়া তার আবিষ্কৃত বিষ ‘অ্যাকুয়া টোফানা’কে একটি প্রসাধনীর নাম দিয়ে বিক্রি করতে লাগলেন। নারীদের মধ্যে প্রসাধনীর ব্যাপক প্রচলন থাকায়, এর মধ্যে বিষ আছে বলে কেউ সন্দেহ করতো না। এভাবেই গিউলিয়ার বেস্ট সেলিং পণ্য হয়ে ওঠে অ্যাকুয়া টোফানা।

সাধারণ প্রসাধনীতে যেসব উপকরণ থাকতো; লিড, আর্সেনিক এবং ব্যালাডোনার সংমিশ্রণে তৈরি অ্যাকুয়া টোফানাতেও সেসব উপকরণ ব্যবহৃত হতো। তাই নারীরা এই প্রসাধনী সহজেই তাদের সাথে বহন করতে পারতো। স্বামীদের কোনো ধারণাই ছিল না, তাদের স্ত্রীদের প্রসাধনীতেই জারি হবে তাদের মৃত্যু পরোয়ানা!

গ্রাহকদের কাছে ‘অ্যাকুয়া টোফানা’ নামে পরিচিত হলেও, কাচের তৈরি বোতলের গায়ে লেখা থাকতো ‘মানা অব সেইন্ট নিকোলাস অব বারি।’ মুখের দাগ দূর করতে একটি জনপ্রিয় তেল হিসেবে পরিচিত ছিল এই প্রসাধনীটি।

গিউলিয়া তার বিষকে দুটি উপায়ে বিতরণ করতেন : পাউডার মেকআপ অথবা সেইন্ট নিকোলাস অব বারি নাম লেখা ছোট্ট শিশিতে। তাই সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না।

গিউলিয়ার তৈরি বিষের আরও একটি অদ্বিতীয় উপকরণ ছিল এর হত্যা করার ক্ষমতা, যা যেকোনো ব্যক্তিকে সুচারূভাবে ধোঁকা দিতে সক্ষম। প্রথম ডোজকে এক ধরনের তরলের সঙ্গে মেশানো হতো, যার ফলে শারীরিক দুর্বলতা ও শ্রান্তি আসে শরীরে। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর পেটে ব্যথা এবং ভুক্তভোগীর বমি ও আমাশয় শুরু হতো। আর বাকি কাজটা তৃতীয় এবং চতুর্থ ডোজ দিয়ে সেরে ফেলা হতো। বিষের প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে জটিল ও মারাত্মক হয়ে উঠতো। এর কার্যপ্রক্রিয়ার ফলে চিকিৎসকরা ধরে নিতেন, রোগী কোনো অজ্ঞাত বা সাধারণ রোগেই মারা গেছে।

গিউলিয়া যে শুধু বিষ বিতরণ করতেন তা নয়; কীভাবে এই বিষ প্রয়োগ করতে হবে এবং পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ কী হবে, সে বিষয়েও নির্দেশনা দিতেন তিনি। তিনি গ্রাহকদের শেখাতেন কিভাবে স্বামী মারা যাওয়ার মুহূর্তে কাঁদতে হবে এবং মৃহদেহ পরীক্ষার দাবি জানাতে হবে, যাতে করে সবার চোখে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া যায়।

বিষ বেচাকেনার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সাবধানী থাকতেন গিউলিয়া। শুধুমাত্র পরিচিত নারীদের কাছে অথবা তার আগের ক্রেতার পরিচিত নারীদের কাছেই তিনি বিষ বিক্রি করতেন। গিউলিয়া তার অন্ধকার জগতের রাজত্ব প্রায় ২০ বছর ধরে চালিয়ে যান। শুধুমাত্র পালের্মোর ওই নারী তার স্বামীকে স্যুপ খেতে নিষেধ করার পরেই গিউলিয়ার পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়।

ইতালির নারীরা গিউলিয়াকে ভালোবাসতো। কারণ তিনি দুর্বল ও ক্ষমতাধর, দুই পক্ষকেই সাহায্য করতেন। কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেপ্তার করতে আসার আগে তিনি নিজের পক্ষে কথা বলার সুযোগ পান এবং স্থানীয় একটি গির্জায় তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়। কিন্তু গিউলিয়া গির্জার পানি সরবরাহ লাইনেও অ্যাকুয়া টোফানা বিষ মিশিয়েছেন বলে গুজব রটে গেলে গির্জা কর্তৃপক্ষের মত পাল্টে যায় এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারের পর নির্মমভাবে অত্যাচার করা হলে গিউলিয়া স্বীকার করেন, ১৬৩৩ থেকে ১৬৫১ সালের মধ্যে তিনি বিষ বিক্রির মাধ্যমে ৬০০ পুরুষকে হত্যা করেছেন।

কিংবদন্তি অনুযায়ী, গিউলিয়াকে ১৬৫৯ সালে রোমের ক্যাম্পো দে’ ফিওরিতে তার মেয়ে ও তিন সহযোগীসহ মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এছাড়াও, গিউলিয়ার ৪০ জন গ্রাহককেও মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তবে এই গ্রাহকেরা ছিলেন সমাজের নিম্ন শ্রেণির নারী। উচ্চ শ্রেণির নারী গ্রাহকেরা এই বলে বেঁচে যান যে তারা জানতেনই না, তাদের প্রসাধনীতে বিষ মেশানো আছে!

কিন্তু সত্যি কি গিউলিয়া এভাবেই মারা গিয়েছিলেন?

গত ৪০০ বছর ধরে একাধিক ব্যক্তি গিউলিয়ার মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার মৃত্যুকে ঘিরে নানা চক্রান্তের কথাও শোনা যায়। অনেকের ভাষ্যে, তাকে কখনো গ্রেপ্তারই করা যায়নি এবং তিনি স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, গিউলিয়াকে ১৭০৯ সালে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় এবং অবিশ্বাস্যভাবে ১৭৩০ সালে তাকে আবারও মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়!

শেষোক্ত তারিখকে যদি আমরা সত্য বলে ধরে নেই, তাহলে বলা যায়, গিউলিয়ার মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ১০০ বছরেরও বেশি। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত যে ১৬৫০ এর দশকের মধ্যেই তিনি তার নেটওয়ার্কের নেতা হিসেবে কাজ করা ছেড়ে দেন।

আবার এর বিপরীত দাবি পেশ করে কেউ কেউ বলেন, গিউলিয়ার ত্রাসের রাজত্ব আরও অনেক বছর কায়েম ছিল এবং তাকে ১৭০৯ সালে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের পর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।

১৬৫৯ সালের মধ্যে গিউলিয়ার নেটওয়ার্কের বহু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু বাকিরা রোমে পালিয়ে যান এবং সেখানে আবারও অ্যাকুয়া টোফানা প্রস্তুত করতে শুরু করেন তারা! নেটওয়ার্ক সচল না থাকলেও গিউলিয়ার বিষ তৈরির রেসিপি ইতালির সব ওষুধ প্রস্তুতকারক দোকানে পাওয়া যেত।

গিউলিয়া টোফানার এই দুর্ধর্ষ উপাখ্যানের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ দিক অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে বাঁচতে বিষ প্রয়োগ করা নাকি এই ভয়ঙ্কর অভিসন্ধি বাস্তবায়নে সাহায্যকারী কালোবাজারিরা, সেই প্রশ্নের উত্তর পাঠকের উপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক।

ইতালীয় নারীদেরকে অসুখী বিয়ের মতো শৃঙ্খল থেকে উদ্ধার করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও, গিউলিয়া ও তার বিষের আখ্যান ইতিহাসের অতল গহ্বরেই চাপা পড়ে গেছে।

Related posts

কী ঘটেছিল সন্ত্রাসবিরোধী রাজু দিবসে?

News Desk

শেরেবাংলার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো কিশোর মুজিব

News Desk

স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ইতিহাস

News Desk

Leave a Comment