Image default
বিনোদন

যেভাবে দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন পপগুরু আজম খান

এদেশের সংগীতপ্রিয় মানুষের কাছে তিনি পপগুরু। কেউ পপ সম্রাট বলেও সম্মানিত করেন। তিনি আজম খান। দেশীয় ফোক ফিউশনের সাথে পাশ্চাত্যের যন্ত্রপাতির ব্যবহার করে বাংলা গানের এক নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন। অনেকে তাকে বাংলাদেশের বব মার্লে বা বব ডেলান বলেন।

১৯৫০ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন আজম খান। তার পুরো নাম মাহবুবুল হক খান। বাবার নাম আফতাব উদ্দিন আহমেদ ও মা জোবেদা খাতুন।

পপগুরু আজম খান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তার সাদামাটা জীবনে সংগীতের নানা অর্জন ছাড়া এই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি ছিলো দুর্দান্ত।

তার পরিবারের নানা সদস্য ও যুদ্ধসঙ্গীদের বরাতে পাওয়া নানা তথ্যে দুর্দান্ত সাহসী এক গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে আজম খানকে খুঁজে পাওয়া যায়। কৈশোর থেকেই গানের সঙ্গে মিশে থাকা মানুষটি কী করে এতোটা সাহসী হয়ে অস্ত্র হাতে দেশের স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন; সেই গল্প মনকে নাড়িয়ে যায়, প্রেরণা দেয়।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসংগীত গাইতেন। তাই তার নামটি পাকিস্তানি হায়েনাদের ভয়ংকর শত্রুর তালিকায় ছিলো।

১৯৭১ সালে আজম খানদের বাড়িতেও একদিন অস্ত্র উঁচিয়ে হাজির হয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। আজম খানের খোঁজ করতে এসে তাকে না পেয়ে মা-বোন-বাবাকে তিরস্কার করে গেলেন। ঘরে ফিরে সেই খবর শুনে মনে জিদ চেপে যায়। বাবাকে বললেন, ‘যুদ্ধে যাব’। বাবা সায় দিয়ে বলেছিলেন, ‘যাবি, দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরবি না!’

সেই জেদ আর দেশের স্বাধীনতা আনার প্রতিজ্ঞা নিয়ে গিটার ফেলে গানের বন্ধুদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। কুমিল্লা বর্ডার পেরিয়ে ত্রিপুরার আগরতলা হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে গেলেন মেলাঘরে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের ২নং সেক্টরে মেজর এটিএম হায়দারের কাছে দুই মাস গেরিলার যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর।

প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টার পর সদলবলে সবাই ক্যাম্পে আত্মশক্তি জাগানোর জন্য বাটি, চামচ, ক্যান, কৌটা, ডিব্বা পিটিয়ে বাজিয়ে সবাই মিলে গাইতেন গণসংগীত।

প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে কুমিল্লার সালদায় প্রথম সম্মুখ সমরে অংশ নেন আজম খান। তার কন্যা ইমা খান থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, কখনও ভয়াবহ যুদ্ধের সময় অসুস্থ হয়ে পড়তেন আজম খান। সালদা নদীর পানিতে দীর্ঘসময় ডুবে থেকে সাঁতরে অস্ত্রবাহী নৌকা পারাপারের ফলে প্রচন্ড জ্বরে ভুগছিলেন একবার।

তবে সব প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কুমিল্লার অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তার সঙ্গে বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন জাকির, রুমিন, সাবু, ফোয়াদ ও ছোটভাই খোকা। কুমিল্লার অপারেশনে সাফল্য পাওয়ায় ঢাকার একটি গেরিলা গ্রুপের সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয় আজম খানকে।

তিনি যাত্রাবাড়ি, ডেমরা, গুলশানসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সম্মুখ সমরের নেতৃত্ব দেন। গেরিলা অপারেশন ‘ক্র্যাক প্লাটুন’র অন্যতম সদস্য ছিলেন আজম খান।

যুদ্ধের মাঝে হঠাৎ খবর এলো ছোটভাই খোকাকে ধরে নিয়ে গেছে হানাদাররা; নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভাইকে পাকিস্তানীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি।

বাবাকে দেয়া কথা রেখেছিলেন আজম খান। যুদ্ধে গিয়ে দেশ স্বাধীন করেই ঘরে ফিরেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন দেশে ফিরেও তার হৃদয় শান্ত হয়নি। পাকিস্তানিদের অত্যাচারে সারা দেশে ধ্বংসস্তুপ, লাশ, গণকবর দাগ কাটে তার মনে। বুকভরা হাহাকার নিয়ে তাই কণ্ঠে তুলেছিলেন, ‘হায়রে হায় বাংলাদেশ’।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ৫ জুন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোকে পাড়ি জমানো এ শিল্পী এখনও বাংলা গানের জগতে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছেন।

Related posts

‘গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্টে’ ফিরে এল রবি শংকর-হ্যারিসনের স্মৃতি

News Desk

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নেতৃত্বে কাজী হায়াৎ-শাহীন সুমন

News Desk

আবারো কলকাতার সিনেমায় ফারিয়া

News Desk

Leave a Comment