Image default
জীবনী

ব্রিটেনের মানসপুত্র স্যার উইনস্টন চার্চিল

উইনস্টন চার্চিল (৩০শে নভেম্বর, ১৮৭৪ – ২৪শে জানুয়ারি, ১৯৬৫) ইংরেজ রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিক পরিচিত। চার্চিলকে যুক্তরাজ্য ও বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রথম জীবনে তিনি ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সদস্য ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০০২ সালে বিবিসির এক জরিপে তিনি সর্বকালের সেরা ব্রিটেনবাসী হিসেবে মনোনীত হন।

প্রায় ৫০ বছর তিনি রাজনীতির প্রথম সারিতে ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে ক্যাবিনেটের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০০ সালে তিনি হাউস অফ কমন্সে নির্বাচিত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে তিনি প্রেসিডেন্ট অব দ্য বোর্ড অব দ্য ট্রেড, হোম সেক্রেটারি ও যুদ্ধকালে আসকুইথ লিবারেল গর্ভমেন্টের ফার্স্ট লর্ড অব দ্য অ্যাডমিরালটির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রয়্যাল স্কটস ফাসিলিয়ার্সের ৬ নাম্বার ব্যাটেলিয়ানের ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে মিনিস্টার অব মিউনিশনস, সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ওয়ার এবং সেক্রেটারি অব স্টেট ফর এয়ারের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধের পর রক্ষণশীল বাল্ডউইন সরকারের (১৯২৪-২৯)চ্যান্সেলর অব দ্য এক্সচেকুয়ার ছিলেন। ত্রিশের দশকে তিনি হিটলারের উত্থান নিয়ে সচেতন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আবার ফার্স্ট লর্ড অব দ্য অ্যাডমিরালটি নিযুক্ত হন। যুদ্ধকালেই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন। সে সময় তার বক্তৃতা ও রেডিও কথামালা ব্রিটিশদের খুবই প্রভাবিত করে। তার সফল নেতৃত্বের কারণে জার্মান বাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়। তিনি কূটনীতিতে বেশ পারদর্শী ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল মৈত্রী গড়ে তুলেন। তার শাসনামলে ভারতে রাখা কিছু ভূমিকার কারণে তিনি বিতর্কিত হন। বিশেষ করে যুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষের জন্য তাকে দায়ী করা হয়। ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি হারলে তিনি বিরোধী দলীয় নেতা হন। ১৯৫১ সালে আবার তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। অবসর নেন ১৯৫৫ সালে।

জন্ম, শৈশব ও পড়ালেখা:

স্যার উইনস্টন চার্চিলের পুরো নাম উইনস্টন লিওনার্ড স্পেন্সার চার্চিল। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান চার্চিল ১৮৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর অক্সফোর্ডশায়ারে দাদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। দাদা জন স্পেন্সার চার্চিল ছিলেন সেসময়কার ডিউক। বাবা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ লর্ড র‍্যান্ডলফ চার্চিল ও মা জেনি জেরোমের দুই ছেলের মধ্যে উইনস্টন চার্চিলই বড়, ছোট ভাই জ্যাক চার্চিল (১৮৮০-১৯৪৭) মিলিটারি অফিসার ছিলেন।

চার্চিলের শৈশব, কৈশোর দুই-ই কাটে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে। তখনকার ডিউক ছিলেন তার দাদা, আর তারই রাজনৈতিক কর্মকর্তা ছিলেন তার বাবা। পারিবারিক পরিবেশেই পড়ালেখার হাতেখড়ি। ছোটবেলা থেকে তিনি স্বাধীনচেতা ও বিদ্রোহী স্বভাবের ছিলেন। একাডেমিক রেকর্ড খুব একটা ভালো ছিল না। প্রায়শ শাস্তিও পেতেন। স্বাধীনচেতা চার্চিল পড়ালেখায় ছিলেন বরাবরই উদাসীন। আর তার ছাপও পড়লো পরীক্ষার ফলাফলে। ১৮৮৮ সালে লন্ডনের হ্যারোও আবাসিক স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু এর কয়েক সপ্তাহ পরই তিনি যোগদান করেন হ্যারোও রাইফেল কর্পোরেশনে এবং কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন সেনাবাহিনীকে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ভারত, সুদান, মিশরসহ কয়েকটি দেশে মিলিটারি সার্ভিসে নিযুক্ত ছিলেন। বাবা-মাকে খুব বেশি কাছে পাননি চার্চিল, তবুও তাদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। এমনটাও কথিত আছে যে, চার্চিল তার বাবাকে চিনেছেন অন্যদের মুখ থেকে, বাবা-ছেলের ঘনিষ্ঠতা থেকে নয়। মা জেনিন জেরোমও খুব একটা যেতেন না ছেলেকে দেখতে, যদিও চার্চিল প্রায়ই মাকে চিঠি লিখতেন। তার যখন ২১ বছর বয়স, তখন তার বাবা মারা যান, যার ফলে বাবা-ছেলের দূরত্বটা কখনোই মেটেনি।

সেনাবাহিনীতে যোগদান ও দাম্পত্য জীবন:

চার্চিল তার ঘটনাবহুল সৈনিক জীবনকে খুবই উপভোগ করছিলেন। ১৮৯৫ সালের পর ব্রিটেনের চতুর্থ রানীর নিজস্ব অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগদান করেন এবং সুদানের সীমান্তে অবস্থান করেন, যেখানে তিনি অমদুরমানের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে পাইওনিয়ার মেইল এবং ডেইলি টেলিগ্রাফকে নিয়মিত প্রতিবেদন লিখতেন। এসকল অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তিনি লিখেছেন ‘দ্য ম্যালাকান্ড ফিল্ড ফোর্স’ (১৮৯৮), ‘দ্য রিভার’ (১৮৯৯) এর মতো বিখ্যাত বই।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অধিক সমাদৃত স্যার উইনস্টন চার্চিল সাহিত্যকর্মেও ছিলেন জগতখ্যাত। ১৮৯৯ সালে চার্চিল সেনাবাহিনী ত্যাগ করে মর্নিং পোস্টের একটি রক্ষণশীল দৈনিক পত্রিকায় যোগদান করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বোয়ার যুদ্ধ চলাকালে একটি স্কাউটিং অভিযানে তিনি আটক হন। মোজাম্বিকের পর্তুগিজ অঞ্চল থেকে ৩০০ মাইল ভ্রমণ করে তিনি আবার ব্রিটেনে ফিরে আসেন। এই অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন তার বই ‘লেডিস্মিথ’ (১৯০০) এ। তার স্ত্রীর নাম ক্লেমেন্টাইন ওগিলভি হোজিয়ের। তাদের প্রথম দেখা হয় ১৯০৪ সালে এবং ১৯০৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বিয়ে করেন। পাঁচ সন্তানের বাবা-মা ছিলেন ইতিহাসখ্যাত এই দম্পতি।

রাজনীতিতে যোগদান:

১৯০০ সালে ম্যানচেস্টারের ওল্ডহ্যামের কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য হিসেবে যোগ দেন উইনস্টন চার্চিল। বাবার স্বাধীন চেতনাকে অনুসরণ করে সামাজিক সংস্কারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন নিজেকে। তার এই স্বাধীনচেতা ভাবনার সাথে মিল না থাকায় তিনি কনজারভেটিভ পার্টি ছেড়ে ১৯০৪ সালে লিবারেল পার্টিতে যোগ দেন। ১৯০৮ সালে লিবারেল পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বোর্ড অফ ট্রেডের সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সদ্য নিযুক্ত চ্যান্সেলর লয়েড জর্জের সাথে নৌবাহিনী সম্প্রসারণের বিরোধিতা করেন তিনি। এছাড়াও কারাগার ব্যবস্থার জন্য বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেন। তিনিই প্রথম শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি চালু করেন এবং শ্রম বিনিময় ও বেকারত্ব বীমা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯১১ সালে এডমিরালটির প্রথম লর্ড হিসেবে নিযুক্ত হন উইনস্টন চার্চিল। ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে আধুনিকায়নে সহায়তা করেন এবং যুদ্ধজাহাজগুলোতে কয়লাভিত্তিক ইঞ্জিনের পরিবর্তে তেলে চালিত ইঞ্জিন ব্যবহারের নির্দেশ দেন, যা ছিল একটি অভাবনীয় সিদ্ধান্ত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ:

চার্চিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু অবধি নিজ পদে বহাল থাকেন, কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিপদজনক গালিপোলির যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণ দর্শাতে বাধ্য করেন তৎকালীন সরকারকে। যার দরুন ১৯১৫ সালের শেষের দিকে সরকার থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। অল্প সময়ের জন্য তিনি আবার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯১৭ সালে পশ্চিমা ফ্রন্টের রয়েল স্কট ফিউসিলিয়ার্সের যুদ্ধে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ পর্যবেক্ষণে একটি ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব পালন করেন সাবেক এই সেনা সদস্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরে তিনি অস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও চার্চিলের ভূমিকা:

১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিনই চার্চিল এডমিরালটির প্রথম লর্ড ও যুদ্ধ সভার সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৪০ এর এপ্রিলে তিনি সামরিক সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন। মে মাসের দিকে জাতীয় সংসদে নরওয়েজিয় সংকটের কারণে প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেইনের উপর সবাই আস্থা হারিয়ে ফেলে। একই কারণে ১৯৪০ সালের ১০ মে রাজা ষষ্ঠ জর্জ চার্চিলকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই জার্মান সেনাবাহিনী নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গ আক্রমণ করে, যা মিত্রবাহিনীর ওপর প্রথম বড় আক্রমণ ছিল।

দুদিন পর অ্যাডলফ হিটলারের জার্মান বাহিনী ফ্রান্সে প্রবেশ করে। ব্রিটেন তখন হিটলারের জার্মান সেনাবাহিনীকে একাই প্রতিহত করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হওয়ার পর তৎক্ষণাৎ তিনি লেবার, লিবারেল ও কনজারভেটিভ পার্টির নেতাদের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবানদের নিযুক্ত করেন গুরুত্বপূর্ণ সব পদে। ১৯৪০ সালের ১৮ জুন ‘হাউজ অফ কমন্স’ এ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন স্যার উইনস্টন চার্চিল। ততদিনে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্মিলিত হয়ে গেছেন।

১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে প্রবেশ চার্চিলকে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তার সুকৌশলী যুদ্ধনীতি ও মিত্রপক্ষের সম্মিলিত জোটের কাছে জার্মান বাহিনী পরাজিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে সামাজিক সংস্কারের পরিকল্পনা করেন তিনি, কিন্তু তা তিনি সাধারণ জনতাকে বোঝাতে পারেননি। যার ফলে ১৯৪৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। পুনরায় প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচনে পরাজয়ের ছয় বছরের মধ্যে তিনি প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন এবং বৈশ্বিক সম্পর্কের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলছিলেন। ১৯৪৬ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি তার বিখ্যাত ‘আয়রন কার্টেন’ ভাষণ প্রদান করেন, যা ছিল ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্যের ওপর সতর্কবাণী। ১৯৫১ সালের নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন এবং দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন।

উইনস্টন চার্চিল হিরো নাকি ভিলেন?

জরিপে যিনি সর্বকালের সেরা ‘ব্রিটিশ’ বলে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনি উইনস্টন চার্চিল। সেই দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হিরো নাকি ভিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তাকে ‘ভিলেন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন ব্রিটেনের বিরোধী দল লেবার পার্টির সংসদ সদস্য (এমপি) জন ম্যাকডোনাল।

১৯১০ সালে খনি শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় চার্চিলের ভূমিকার বিষয়ে সমালোচনা করে তাকে এ আখ্যা দেন ম্যাকডোনাল।

একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ছায়া মন্ত্রিসভার চ্যান্সেলর ম্যাকডোনালকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়।

এরই একপর্যায়ে প্রশ্ন করা হয়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মিত্রশক্তির অন্যতম শীর্ষনেতা ও ব্রিটেনের দুবারের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ‘হিরো’ নাকি ‘ভিলেন’? এমন প্রশ্নের জবাবে ম্যাকডোনাল বলেন, ‘টনিপ্যান্ডি-ভিলেন!’

সরকারি ব্যবস্থাপনার প্রতি খনি শ্রমিকদের ক্ষোভ-অসন্তোষের বহির্প্রকাশ হিসেবে সাউথ ওয়েলসের রোন্ডা এলাকায় এ খনি আন্দোলন ছড়িয়েছিল।

এ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় গড়ায়। সহিংস এই আন্দোলনই পরিচিত হয় ‘টনিপ্যান্ডি রায়ট’ বলে।

সহিংসতা বন্ধে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চার্চিল সেখানে সেনাবাহিনী পাঠান। ওই আন্দোলনে একজন নিহত, অনেকে আহত এবং বেশ কয়েকজন শ্রমিক গ্রেফতার হন।

মানবাধিকার নেতারা ওই সিদ্ধান্তকে ‘শ্রমিক-অধিকারবিরোধী অবস্থান’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এ ছাড়া চার দশক পর ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচনী প্রচারে চার্চিলকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, যে জন্য ব্রিটিশ এ রাজনীতিক অনুশোচনা প্রকাশ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপসহ মিত্রশক্তিকে অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সেই সময়ের চার্চিলকে তার অনুসারীরা মহান নেতা হিসেবে সম্মান করেন।

এ ছাড়া ২০০২ সালে সর্বকালের সেরা ব্রিটিশ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন চার্চিল।

তবে ম্যাকডোনাল ভিলেন বললেও চার্চিলকে সেই সম্মানের স্থানেই রাখছেন লেবার পার্টির অন্য এমপিরা।

ওই দলের আরেক এমপি ইয়ান অস্টিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চার্চিলের ছবি পোস্ট করে লেখেন- ‘একজন সত্যিকারের ব্রিটিশ হিরো, সর্বকালের সেরা ব্রিটিশ, যিনি নাজিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রিটিশদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন এবং কেবল আমাদের স্বাধীনতার জন্য নয়, বিশ্বের মুক্তির জন্যও লড়াই করেছিলেন।’

বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাট হ্যানককও টুইট করে বলেছেন, ‘চার্চিল ছিলেন সর্বকালের সেরাদের একজন।’

সমালোচনা:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বাংলায় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল (১৯৪৩ সালে) সেজন্যে অনেকেই চার্চিলের নীতিকে দোষারোপ করে থাকেন।যে দুর্ভিক্ষে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

লেখা:চার্চিল শুধু রাজনীতিবিদ বা সুবক্তাই ছিলেননা তার লেখার প্রভূত সম্ভার ইংরেজি ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। সৈনিক জীবনেই তিনি যে রিপোর্ট গুলি পাঠাতেন তা ছাপা হয় ‘দি পাওনিয়র’ ও ‘ডেলি টেলিগ্রাফ’ এ। আত্মজৈবনিক রচনার জন্যে সাহিত্যে নোবেল পান ১৯৫৩ তে। তার বৈচিত্র্যময় ও বিস্তৃত লেখার সম্ভারের মধ্যে একটিই মাত্র ছোটগল্প লেখেন। তার নাম ‘ম্যান ওভারবোর্ড'[১]

এছাড়া তিনি চল্লিশটির বেশি বই রচনা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস। ১৯৫৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার উল্লেখযোগ্য বই হল- দ্য স্টোরি অব দ্য মালাকান্ড ফিল্ড ফোর্স (১৮৯৮), দ্য রিভার ওয়ার (১৮৯৯), সাভরোলা (১৯০০), লন্ডন টু লেডিস্মিথ ভায়া প্রেটোরিয়া (১৯০০), আয়ান হামিল্টনস মার্চ (১৯০০), লর্ড রানডলফ চার্চিল (১৯০৬), মাই আর্লি লাইফ: আ রোভিং কমিশন (১৯৩০), গ্রেট কনটেম্পরিয়াস (১৯৩৭), দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার (১৯৪৮-৫৪) ও আ হিস্ট্রি অব দ্য ইংলিশ-স্পিকিং পিপলস (১৯৫৬-৫৮)।

উইনস্টন চার্চিল এর অজানা কিছু তথ্য:

একবিংশ শতাব্দীর এজন সম্মানিত ও দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৮৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর ইংল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন উইনস্টন চার্চিল। ইতিহাসের সফলতম এই রাষ্ট্রনায়ক ছাত্র হিসেবে সাফল্য লাভ করেননি। স্কুলের গন্ডি পেরুতে তাকে ৩টি স্কুল বদলাতে হয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি স্বাধীনচেতা ও বিদ্রোহী স্বভাবের ছিলেন। সামরিক জীবনে প্রবেশ করতে পরীক্ষায় পাশ করেন তিনবারের প্রচেষ্টায়। অথচ তিনিই একসময় ওয়াশিংটন পোষ্টের মত পত্রিকার রিপোর্টার হয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। সফল রাজনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদ চার্চিল চল্লিশটির বেশি বই রচনা করেছেন। ১৯৪০-১৯৪৫ ও ১৯৫১-১৯৫৫ এই দুই মেয়াদে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯০৮ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর ক্লেমেন্টাইন হোজিয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন উইনস্টন চার্চিল। দাম্পত্য জীবনে তারা পাঁচ সন্তানের জনক জননী। নানা বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি। খ্যাতিমান এই রাজনীতিবিদের অনেক মজার ঘটনা আছে যেমন :

১। ইন্ডিয়া ভ্রমণের পর থেকে তিনি হুইস্কি খাওয়ার প্রতি আসক্ত হন

উইনস্টন চার্চিল এর বিখ্যাত উক্তি ছিল, “খাওয়ার মাঝখানে মদ্যপ পানীয় পান পান করবো না এটাই আমার জীবনের নিয়ম করে নিয়েছিলাম”। তিনি ভারত ভ্রমণের আগ পর্যন্ত হুইস্কি অপছন্দ করতেন। তিনি ভারত ভ্রমণে এসে শিখেছিলেন কিভাবে সঠিক ভাবে হুইস্কি পান করতে হয়। এখানে তিনি জনি ওয়াকার হুইস্কি সোডার সাথে পান করতেন।

২। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চমকে দিয়েছিলেন

অন্যরা কি ভাবছে তা তিনি মোটেই গ্রাহ্য করতেননা, এমনকি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে ও না। তিনি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সামনেই হঠাৎ করে স্নানের তোয়ালে খুলে ফেলে বলেছিলেন, “লুকানোর কিছু নেই”।

৩। তিনি পশুদের পছন্দ করতেন

অনেকেই ব্রিটিশ বুলডগকে চার্চিলের পছন্দের মনে করতেন। কিন্তু এই রাজনীতিবিদের পছন্দের ছিলো বিড়াল, বিশেষ করে জক নামের বিড়াল যার কমলা রঙের দেহে সাদা দাগ ছিলো। যার নামকরণ করা হয়েছিলো চার্চিলের ব্যক্তিগত সচিব স্যার জন জক কলভিল এর নামে।

৪। তিনি সিনেমা দেখতে পছন্দ করতেন

তিনি পরিবারের সদস্য, মেহমান ও কর্মচারীদের নিয়ে নিয়মিত সিনেমা দেখতেন। তার পছন্দের চলচ্চিত্র ছিলো “দ্যাট হেমিল্টন ওমেন”। তিনি সঙ্গীত পছন্দ করতেন।

৫। তাঁর মা তাকে ধূমপান পরিহারের জন্য প্রলুব্ধ করতে ঘুষ দিয়েছিলেন

চার্চিলের বয়স যখন ১৫ বছর তখন তাঁর মা ছেলেকে শর্ত দিয়েছিলেন, যদি চার্চিল আগামী ছয় মাস ধূমপান না করে থাকতে পারে তাহলে তাকে একটি বন্দুক ও একটি টাট্টু ঘোড়া উপহার দিবেন। তিনি এতে সফল হয়েছিলেন তবে সেটা সব সময়ের জন্য নয়।

৬। তিনি তাঁর মেয়ের জামাইকে পছন্দ করতেন না

চার্চিলের মেয়ে সারা যে ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন তাকে তিনি দুচোখে দেখতে পারতেন না। একদিন দুজনে হাঁটতে বেরিয়েছেন। এ সময় মেয়ে জামাই প্রশ্ন করল, যুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রশংসাযোগ্য কাজ করেছেন এমন কেউ আছেন কি? চার্চিল প্রায় গর্জন করে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, একজন আছেন, মুসোলিনি। তিনিই একমাত্র লোক যে কিনা নিজের মেয়ে-জামাইকে গুলি করে মারার সাহস দেখিয়েছিলেন”।

আরো কিছু তথ্য : তিনি ছিলেন একজন ফ্যাশন সচেতন মানুষ, তিনি সময় নষ্ট করতেন না, তিনি ক্রিম স্যুপের পরিবর্তে স্বচ্ছ স্যুপ পছন্দ করতেন, তিনি একমাত্র ব্রিটিশ যাকে প্রথম সম্মানসূচক আমেরিকার নাগরিকত্ব দেয়া হয়, ১৯৪৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে দুর্ভিক্ষের জন্য তার নীতিমালা দায়ী ছিলো বলে মনে করা হয়, দুই আঙ্গুলে ভি চিহ্ন দেখিয়ে বিশ্বে সাড়া ফেলেছিলেন তিনি।

নোবেল বিজয় ও মৃত্যু:

১৯৫৩ সালে ২য় রানী এলিজাবেথ স্যার উইনস্টন স্পেন্সার চার্চিলকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। একই সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৫ সালের ১৫ জানুয়ারি গুরুতর স্ট্রোক করেন চার্চিল, এর ঠিক ন’দিন পর ১৯৬৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ব্রিটেনের এই মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তার লন্ডনের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে সেন্ট মার্টিন চার্চের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তার ওপর লেখা হয়েছে বেশ কিছু বই। সম্প্রতি তার জীবনী নিয়ে বানানো ‘ডার্কেস্ট আওয়ার’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন গ্যারি ওল্ডম্যান এবং এতে এই অভিনেতা অস্কার লাভ করেন।

তথ্য সূত্র:
1.https://bn.wikipedia.org/
2.https://www.jugantor.com/
3.https://roar.media/
4.https://www.priyo.com/

Related posts

রাজা রামমোহন রায়, বাংলার নবজাগরণের আদি পুরুষ

News Desk

বাংলার নায়ক জসিমের জীবনী, শিক্ষা, ফ্যামিলি,চলচ্চিত্র, সিনেমা, এবং সম্পূর্ণ প্রোফাইল

News Desk

স্যার ফজলে হাসান আবেদ : গ্রামবাংলার পালাবদলের স্বপ্নদ্রষ্টা

News Desk

Leave a Comment