Image default
বাংলাদেশ

হাসেম ফুড কারখানায় ৫৪ মৃত্যু, ১ বছরেও শেষ হয়নি তদন্ত

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত এক বছরেও শেষ হয়নি। অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় কারখানার মালিক আবুল হাসেমসহ আট জনের নামে মামলা করেছিল পুলিশ। কিন্তু এখনও মামলার তদন্তকাজ শেষ না হওয়ায় আক্ষেপ করেছেন নিহতদের স্বজনরা। বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

নিহতদের স্বজনরা বলছেন, ‘এক বছর পার হয়ে গেছে, এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। কবে বিচার পাবো? বিচার পাবো কিনা জানি না। এত মানুষের মৃত্যুর কথা সবাই ভুলে গেছে। অথচ এখনও স্বজন হারানোর কষ্ট আমাদের তাড়া করে বেড়ায়।’

এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন খাদিজা আক্তার (১৮)। কারখানার পাশের নতুন বাজার এলাকায় তার মা সুফিয়া বেগম বসবাস করেন। খাদিজার জন্য এখনও কাঁদছেন তিনি। বিচার না পাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আমি বেঁচে আছি জিন্দা লাশ হয়ে। মেয়েকে হারিয়ে ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না। কেঁদে কেঁদে প্রতিরাত পার করি। আজও মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। বিচার পাবো কিনা জানি না।’

ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়ে কি হবে? সরকারিভাবে দুই লাখ ও কারখানার মালিক দুই লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন। ক্ষতিপূরণ দিলেই কি বিচার হয়ে যায়। আমি তো আর মেয়েকে ফিরে পাবো না। অন্তত বিচার পেলে স্বস্তি পেতাম।’

আরও পড়ুন: হাসেম ফুড কারখানায় আগুন: ৪৫ মরদেহ শনাক্ত

একমাত্র মেয়ে শান্তামণির মরদেহ আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল। দেখে চেনার উপায় ছিল না। পরে ডিএনএ পরীক্ষা করে মরদেহ শনাক্ত করা হয়।  শান্তামণির মাকে সরকারিভাবে দুই লাখ ও কারখানার মালিক দুই লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন।

বিচার পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে শান্তামণির মা শিমু বেগম বলেন, ‘এক বছরেও বিচার পাইনি, কবে পাবো? ভবিষ্যতে পাবো কিনা জানি না। বিচার না পেলে আমরা স্বস্তি পাবো না। আর বিচার না হলে কারখানায় মৃত্যুর মিছিল চলতেই থাকবে। এজন্য দোষীদের বিচার হওয়া জরুরি।’

এ মামলা তদন্ত করছেন সিআইডির নারায়ণগঞ্জ জোনের পরিদর্শক মো. আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় আট জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছিল। আসামিরা সবাই জামিনে আছেন। মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। তদন্ত শেষ হলেই আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’

আরও পড়ুন: সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ৮ জন রিমান্ডে

তিনি আরও বলেন, ‘হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস ৪৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে এবং তিন জন কারখানার ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন। পরে মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। আমরা ওই ভবনে অভিযান চালিয়ে কারখানার পুড়ে যাওয়া মালামালের স্তূপের নিচ থেকে মাথার খুলি, চুল, সাতটি হাড়সহ শরীরের বিভিন্ন পোড়া অংশ উদ্ধার করেছি। সেগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করে তিন জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত ৫৪ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। এ ঘটনায় আর কেউ নিখোঁজ নেই।’

পুড়ে যাওয়ার পর হাসেম ফুড কারখানাটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়

নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, ‘এ মামলায় আট আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা সবাই এখন জামিনে। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন এখনও আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। প্রতিবেদন জমা হলে বিচার শুরু হবে।’

আরও পড়ুন: দেশ ছেড়ে পালাবো না: সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান

এ বিষয়ে সজীব গ্রুপের এজিএম (অ্যাডমিন) ক্যাপ্টেন (অব.) মো. মামুনুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগুনে পুড়ে যাওয়া কারখানাটি এখনও পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। প্রশাসন ভবনটি সিলগালা করে দিয়েছিল। সংশ্লিষ্টদের ক্লিয়ারেন্স পেলে ভবনটি চালু করা সম্ভব হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে দুই লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে।’

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া বলেন, ‘আগুনে পুড়ে যাওয়া কারখানার ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কারখানা চালুর জন্য যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলো পূরণ করেছে কর্তৃপক্ষ। কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কারখানার অন্যান্য ভবন পরীক্ষার পর কার্যক্রম চালনোর অনুমতি দেওয়া হবে।’

কারখানার অন্যান্য ভবন পরীক্ষার পর কার্যক্রম চালনোর অনুমতি দেওয়া হবে

তিনি আরও বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া ৫৪ জনের পরিবারকে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে দুই লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আহত ৩৮ জনকে ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’

আরও পড়ুন: অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা, সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ গ্রেফতার ৮

২০২১ সালের ৮ জুলাই বিকালে রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার ছয়তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন দেখে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিন জনের মৃত্যু হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ১৯ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। তারা ওই কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারী।

এ ঘটনায় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেমসহ আট জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলায় নিরাপত্তা না থাকাসহ বিভিন্ন অবহেলার অভিযোগ আনা হয়। 

পরদিন সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম, তার ছেলে হাসীব বিন হাসেম ওরফে সজীব, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম, তানজীম ইব্রাহীম, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ, হাসেম ফুড লিমিটেডের ডিজিএম মামুনুর রশিদ ও অ্যাডমিন প্রধান সালাউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। ১০ জুলাই তাদের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খাতুন। রিমান্ড শেষে তাদের আদালতে হাজির করলে জামিন মঞ্জুর করেন বিচারক। 

হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার বর্তমান অবস্থা

আরও পড়ুন: ৫২ শ্রমিকের মৃত্যু, হাসেম ফুডের চেয়ারম্যানের দুই ছেলের জামিন

এরপর মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে সিআইডির একটি টিম অভিযান চালিয়ে কারখানার তিন ও চার তলা থেকে মাথার খুলি, চুল ও হাড় উদ্ধার করে। ডিএনএ পরীক্ষা করে সেখানে তিন জনের লাশ ছিল বলে নিশ্চিত করে সিআইডি।

এ ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছিল জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস। গত ৯ আগস্ট প্রতিবেদন দাখিল করে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কারখানাটি ভবন নির্মাণ নীতিমালা (বিল্ডিং কোড) না মেনেই তৈরি করা হয়েছিল। কারখানায় পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র কিংবা ফায়ার সার্ভিসের নো অবজেকশন সার্টিফিকেটও (এনওসি) ছিল না। জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ এ তথ্য জানিয়েছেন। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সিআইডির কাছে জমা দিলেও সেখানে কি উল্লেখ করা হয়েছে, তা জানানো হয়নি।

Source link

Related posts

রাজশাহীতে দুই কৃষকের মৃত্যু: ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি

News Desk

আমন ধান নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিনাজপুরের চাষিরা

News Desk

রামেকর করোনার ইউনিটে ১২ জনের মৃত্যু

News Desk

Leave a Comment