Image default
বাংলাদেশ

বদলেছে পাহাড়ি জনপদ, ফেরেনি স্থিতিশীলতা

পার্বত্য শান্তিচুক্তির রজতজয়ন্তী আজ। এ সময়ে সড়ক যোগাযোগ, পর্যটন ও শিক্ষা খাতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সরকারি-বেসরকারি নানা উন্নয়ন প্রকল্পে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কৃষি ও পর্যটনের ওপর ভর করে পাহাড়ের অর্থনীতি অগ্রসর হচ্ছে। উন্নয়নের মাধ্যমে ধূসর পাহাড় ক্রমশ সবুজ হচ্ছে। তবে পাহাড়ে আজও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরেনি। সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। দীর্ঘদিনেও রাজনৈতিক সংকট কাটেনি। তৎকালীন সংঘাতময় পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ তিন পার্বত্য জেলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, গণসমাবেশ। দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন। পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং জেলা আওয়ামী লীগ আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে গণসমাবেশ ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে।

পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। খাগড়াছড়ির ৩৯৭ কিলোমিটারের পাকা সড়কের পাশাপাশি পাকা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে পর্যটন, কৃষি খাত। পর্যটনের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। বর্তমানের জেলার প্রায় ১ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় পর্যটকদের যাতায়াতের পথ সুগম হয়েছে। খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সবুজ চাকমা জানান, পাহাড়ের সর্বত্র এখন পাকা সড়ক তৈরি হয়েছে। বেইলি ব্রিজের পরিবর্তে পাকা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-বাঘাইহাট সড়কের উন্নয়ন করা হয়েছে। বাঘাইহাট-মাচালং-সাজেক সড়ক দীঘিনালা-ছোটমেরুং-চংড়াছড়ি-লংগদু সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।

শিক্ষা খাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ২০১৭ সাল থেকে মাতৃভাষায় বই পাচ্ছে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিভিন্ন বিদ্যালয়ে একাডেমিক ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণ হওয়ায় শিক্ষা খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। খাগড়াছড়ির শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মৃদুময় চাকমা জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার উন্নয়নে সরকার প্রচুর কাজ করেছে। স্কুল পর্যায়ে সাতটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ১০টি ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। পাঁচটি কলেজের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষা সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে দুটি কলেজে চারটি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট ছাত্রীনিবাস নির্মাণ করা হয়েছে।

সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় দুর্গম এলাকায় সুপেয় পানির বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার বাজারসমূহ ও নিকটবর্তী এলাকায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রকল্প চলছে। এছাড়া জিপিএস এবং এনএনজিপিএস প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প চলছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে নির্বাহী প্রকৌশলী রেবেকা আহসান জানান, জিএফএস এবং সোলারের মাধ্যমে দুর্গম এলাকাগুলো পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে করে মানুষের পানির কষ্ট দূর হয়েছে। খাগড়াছড়িতে ৭০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির আওতায় এসেছে।

পার্বত্য শান্তিচুক্তিকে পাহাড়ের জন্য আশীর্বাদ উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, চুক্তির আগে প্রান্তিক স্তরে অবকাঠামোসহ উন্নয়ন কাজ করার পরিবেশ ছিল না। এখন অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়েছে। সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন হয়েছে। পর্যটন খাতে অর্থ সরবরাহ বেড়েছে। কৃষি খাতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আম, মাল্টা, কাঁঠাল, কলা উৎপাদন বেড়েছে। শান্তিচুক্তির ফলে এসব সম্ভব হয়েছে।

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, শান্তি চুক্তির পর রাস্তাঘাট, সেতু এবং শিক্ষা, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ পাহাড়ে উন্নয়নের ব্যাপক গতি এসেছে। অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে জীবনমানের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু ২৫ বছরেও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফেরেনি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি রাজনৈতিকভাবে স্থায়ী সমাধান। বন্ধ হয়নি রক্তপাত, হানাহানি। একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। আঞ্চলিক দলের একাধিক প্রতিপক্ষ সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষয়ী সংঘাত ঘটছে। অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি রয়ে গেছে। চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। এতে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), প্রতিপক্ষ সংস্কারপন্থি গ্রুপ জেএসএস (এমএন লারমা), ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), প্রতিপক্ষ গ্রুপ ইউপিপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ছাড়াও বর্তমানে মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টসহ (কেএনএফ) বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা বিদ্যমান রয়েছে। এসব সংগঠনের সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে প্রতিনিয়তই ঘটছে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে একাধিক গ্রুপের ক্যাডার বাহিনী। ফলে পাহাড়ে আজও বিরাজ করছে অশান্তি।

চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে গড়ে ওঠে ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের মধ্যকার সংঘাত শুরু হয়। এতে বহু মানুষের প্রাণহানিও হয়েছে। জনসংহতি সমিতি ভেঙে দুই দলে বিভক্ত হয়েছে। ২০১৭ সালের শেষের দিকে ইউপিডিএফ ভেঙে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি আঞ্চলিক সংগঠন গঠিত হয়। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতিতে সংকট তৈরি হয়। সম্প্রতি কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং মগ লিবারেশন পার্টির (এমএলপি) তৎপরতা জনমনে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। জনসংহতি সমিতির দায়িত্বশীলরা বলছেন, চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হয়নি। প্রযোজ্য আইনগুলো সংশোধন করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়নি। শান্তিচুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বাঙালিভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। তারা পার্বত্য চুক্তির সংশোধন করার দাবি জানাচ্ছেন। চুক্তির ধারা সংশোধনের দাবিতে বৃহস্পতিবার সকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। সংগঠনের রাঙামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সোলাইমান বলেন, পার্বত্য চুক্তিসহ কিছু বৈষম্যমূলক আইন পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মাঝে বৈষম্য তৈরি করেছে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে কিছু ধারার সংশোধন করতে হবে।

Related posts

সবচেয়ে বড় কয়লার চালান নিয়ে মোংলা বন্দরে বিদেশি জাহাজ

News Desk

ঢাকা-গাজীপুর রুটে বিশেষ ট্রেন চলবে রবিবার থেকে

News Desk

বগুড়া করোনায় মারা গেলেন আরও ১২ জন

News Desk

Leave a Comment