আগামী ২৫ জুন খুলে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। উদ্বোধনের পর সেতু ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার লোকজন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে যাবেন। সেতুর কারণে সড়ক যোগাযোগে গতি এলেও ঘাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন পেশার মানুষ পড়েছেন বিপাকে। ঘাটকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে যাদের সংসারের চাকা ঘুরছে, তারা জীবিকা নিয়ে পড়েছেন দুশ্চিন্তায়।
স্থানীয়রা জানান, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম নৌপথ মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট। ২৫ জুন পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার প্রভাবে বাংলাবাজার ফেরিঘাট এলাকায় বিরাজ করছে সুনসান নিরবতা। ঘাট এলাকার হকাররা পড়েছেন বিপাকে। তারা বলছেন- সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার লাখ লাখ মানুষের যাতায়াতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে। তবে গুরুত্ব হারাবে বাংলাবাজার ঘাট। বেকার হয়ে পড়বেন ঘাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন পেশার মানুষ।
শুক্রবার (১০ জুন) দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাট এলাকায় অবস্থান করে দেখা গেছে, ফেরিঘাট এলাকা যানবাহন ও জনশূন্য। ঘাটে থাকা খাবার হোটেলের বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক দোকানপাট ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। দুই একটি চায়ের দোকান খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই। অনেকেই দোকানপাট অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়েছেন।
ঘাটের হকার ও স্থানীয়রা জানান, বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ঘাটকে ঘিরে যারা জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যা পড়েছেন হকার শ্রেণি ব্যবসায়ীরা। তারা লঞ্চ, ফেরিতে ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের কাছে আখের রস, ঝালমুড়ি, ছোলা, সেদ্ধ ডিম, সিঙারা, নারকেল-চিড়া, শসা, দইসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার বিক্রি করতেন। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে প্রতিটি লঞ্চে তিন থেকে চার জন করে নানান জিনিস নিয়ে ওঠে খাবার বিক্রি করতেন তারা। ঘাটের পন্টুনে ঘুরে ঘুরেও খাবার বিক্রি করতেন অনেকে। ঘাট দিয়ে যাতায়াতকারী হাজার হাজার যাত্রীই ছিল তাদের ক্রেতা।
বাংলাবাজার লঞ্চ ঘাটে কয়েকজন হকারের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, সেতু চালু হওয়ার খবর আনন্দের। তবে সেতু চালু হলে আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। ঘাটের ওপর নির্ভর করে যুগযুগ ধরে চলা এই ব্যবসা হঠাৎ করেই থেমে যাবে। এখানে অনেকেই আছে ৩০-৪০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। সব বন্ধ হয়ে যাবে। দীর্ঘদিনের পেশা বন্ধ হয়ে গেলে বিপাকে পড়তে হবে। তবে এখনও বিকল্প পেশা নিয়ে চিন্তা তেমন করেননি বলে জানান তারা। এ অবস্থায় হকারদের পুনর্বাসনের দাবি জানান তারা।
হারুন নামে এক ছোলা বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি বলেন, বিকল্প পেশা নিয়ে সেতু নির্মাণের শুরু থেকেই তাদের অনেকের ভাবনা চলছিল। আর মাত্র ১৫ দিন পর সেতুর উদ্বোধন। ইতোমধ্যে অনেকে বাড়ির কাছাকাছি ছোট্ট দোকান দিয়েছেন। আমিও কিছু টাকা জমিয়েছি, আর কিছু টাকা আত্মীয়র কাছ থেকে এনে নিকটস্থ বাংলাবাজার ঘাটে একটি দোকান দেবো।
ছয়ফুল মোল্ল্যা নামে এক চানাচুর বিক্রেতা বলেন, আমার পরিবারের অনেকেই অনেক বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে ওই ব্যবসা সময় দেবো।
মনির নামে আরেকজন বলেন, ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে কেউ কেউ কৃষি কাজে যোগ দেবেন। পাশাপাশি আমরা পদ্মায় মাছ শিকার করে চলতে পারবো। অনেকেই ঢাকা শহরের দিকে ছুটছেন। এছাড়া কয়েকজন ইতোমধ্যে পাসপোর্ট করে দেশ ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন।
লঞ্চ টার্মিনালে বসে বিভিন্ন ধরনের মসলা ও শস্য বিক্রি করনে হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ৮ বছর ধরে এই পেশায় আছি, ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে শুনেছি। তবে এখনও বিকল্প চিন্তা করিনি। দেখি বাড়ির কাছে ছোট একটি দোকান নেওয়া যায় কিনা। আবার দোকানের জন্য মালিককে যে অ্যাডভান্স দিতে হয়, আমি সেটা সংগ্রহ করতে পারবো কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
অটোবাইক চালক জসিম বলেন, যানবাহন ও যাত্রীর সমাগম যত বেশি হয়, আমাদের আয়ও তত বেশি। বর্তমানে ঘাটে যানবাহনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছি। যাত্রী নেই, কারা যাইবো। খুব বিপদে আছি।
বাংলাবাজার লঞ্চঘাট সূত্রে জানা যায়, নৌরুটে ৮৭টি লঞ্চ, ১২৫টি স্পিডবোট, ৫-৬টি ফেরি বর্তমানে চলছে। এ সব নৌযানে প্রায় ১২শ’ শ্রমিক কাজ করেন। এসব শ্রমিকদের অধিকাংশ মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা। ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে অনেককেই পেশা ছাড়তে হবে।
বিআইডব্লিউটিএর বাংলাবাজার ঘাটের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আক্তার হোসেন বলেন, এখনও ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে কিনা তেমন কোনও নির্দেশনা আমাদের কাছে আসেনি। যদি সরকার চায় তাহলে ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।